চৌদ্দ বছর আগে অকল্যান্ডে এক দিন

ক্রিসমাসে সুনসান সিটি অব সেইলস্

উৎপল শুভ্র

১ এপ্রিল ২০২১

ক্রিসমাসে সুনসান সিটি অব সেইলস্

অকল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে ব্যস্ত, সবচেয়ে জনবহুল শহর

অকল্যান্ডে আজ হরতাল নাকি? রাস্তাঘাট এমন সুনসান কেন? হরতাল বস্তুটাার সঙ্গে নিউজিল্যান্ডারদের পরিচয়ই নেই। তারপরও ঘুম থেকে উঠে ক্রাউন প্লাজা হোটেলের ১৮ তলার রুমের পর্দা সরানোর পর হরতালের কথাটাই মনে হলো সবার আগে।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭। প্রথম আলো।

অকল্যান্ডে আজ হরতাল নাকি? রাস্তাঘাট এমন সুনসান কেন?

দাবিটাবি নিয়ে আন্দোলনের ব্যাপারটাই বলতে গেলে নিউজিল্যান্ডারদের কাছে অজানা, আর দাবি আদায়ের জন্য নিজেদের কাজ ফেলে ঘরে বসে থাকার আত্মঘাতী চিন্তাটা তো তাদের কাছে একদম অচিন্তনীয়। এটি জানা থাকার পরও সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্রাউন প্লাজা হোটেলের ১৮ তলার রুমের পর্দা সরানোর পর হরতালের কথাটাই মনে হলো সবার আগে।

কালই হোটেলের সামনের অ্যালবার্ট স্ট্রিট ও একটু দূরের যে কুইন স্ট্রিটে মানুষ গিজগিজ করতে দেখেছি, সেখানে কোনো জনমনিষ্যিই নেই! গাড়িঘোড়াও (গাড়ির সঙ্গে কীভাবে যেন ঘোড়াটাও চলে আসে, ব্যস্ত শহরের রাজপথে ঘোড়া আসবে কোত্থেকে?) নেই। দোকানপাট সব বন্ধ। অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ যে ঘোরঘোর ভাবটা থাকে, সেটি কেটে যাওয়ার পর মনে পড়ল, আজ তো ক্রিসমাস।

ছয় বছর আগে নিউজিল্যান্ডে আরেকটি ক্রিসমাস কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেবার ছিলাম ওয়েলিংটনে। সেদিনও ওয়েলিংটন নিশ্চয়ই এমন সুনসানই ছিল। কিন্তু ছয় বছর তো কম সময় নয়, ভুলেই গিয়েছিলাম ক্রিসমাসের দিনটিতে এই দেশের শহরগুলো এমনই মৃতপুরী হয়ে যায়।

আমাদের দেশে ঈদ বা পূজার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলোতে রাস্তাঘাট আরও বেশি মুখরিত হয়ে ওঠে। ক্রিসমাস দেখছি ব্যতিক্রম। এটি একেবারেই ব্যক্তিগতভাবে উদযাপনের ব্যাপার। পরিবারের সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাটানোর দিন। রাস্তাঘাটে হইচই, উত্সব-আয়োজন যা কিছু হয়, তার সবই ক্রিসমাসের আবাহনে।

আমি হেসে বললাম, ‘কার কাছে কী বলছ! আমি বাংলাদেেশর মানুষ। ঢাকায় আমার পাড়াতেই তো এর চেয়ে বেশি লোক থাকে।’ সিলভিয়া তাঁর নীল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। নির্ঘাত ভেবেছে, আমি রসিকতা করছি।

একটু পর হোটেলের রিসেপশনে নেমে সুনসান শহরের কথা বলতে তরুণী রিসেপশনিস্ট একটু বিস্মিত হয়েই বলল, ‘ক্রিসমাসে তো এমনই হয়। তা ছাড়া প্রচুর লোক ছুটি কাটাতে চলে গেছে। ক্রিসমাসের দিন থেকেই এ দেশে লম্বা ছুটি শুরু হয়।’ এটা যে অকল্যান্ডের আসল চেহারা নয়, আগের দিনই বুঝেছি। সিলভিয়া নামের ওই তরুণীর তা জানার কথা নয়। সেটি বুঝিয়ে দেওয়া দায়িত্ব বলে মনে করে তাই বলল, ‘তুমি কি জানো, অকল্যান্ডে অনেক মানুষ! এখানে নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বাস! শুধু অকল্যান্ড শহরের লোকসংখ্যাই তিন লাখ ৭০ হাজার!’

আমি হেসে বললাম, ‘কার কাছে কী বলছ! আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ঢাকায় আমার পাড়াতেই তো এর চেয়ে বেশি লোক থাকে।’ সিলভিয়া তাঁর নীল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেন। নির্ঘাত ভেবেছে, আমি রসিকতা করছি।

ক্রাউন প্লাজা হোটেলের পাশেই স্কাই সিটি কমপ্লেক্স। ক্যাসিনো, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, বার, হোটেল...কী নেই সেখানে! সবচেয়ে দর্শনীয় হয়ে আছে স্কাই টাওয়ার। মিনারের মতো উঠে যাওয়া ৩২৮ মিটার উঁচু এ স্কাই টাওয়ার এই গোলার্ধের উচ্চতম মনুষ্য-নির্মাণ। লিফটে করে সেটির একদম ওপরে উঠে যাওয়া যায়, সেখানে চারপাশে কাচে ঘেরা ‘অবজারবেশন ডেক’ থেকে চারদিকে অকল্যান্ডের প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকে। তবে সেটির বিনিময়মূল্যটা এমনই বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে যে ট্যুরিস্ট গাইডে পড়া ‘এটি অকল্যান্ডে অবশ্য দ্রষ্টব্য’ পরামর্শটা ভুলে যেতে একদমই সমস্যা হয়নি!

অকল্যান্ডের স্কাই টাওয়ার থেকে বাঞ্জি জাম্পিং দিয়ে যারপরনাই আনন্দিত শচীন টেন্ডুলকার

বাঞ্জি জাম্প দেওয়ার সাহস থাকলে তা-ও একবার হয়তো ঢুঁ মারতাম। শচীন টেন্ডুলকার এখানে বাঞ্জি জাম্প দিয়েছেন, কোন একটা ট্যুরে এসে পুরো ভারতীয় দলই। তবে শচীন শচীন বলেই তাঁর ছবিটা আলাদা করে মনে আছে। ওই ছবিটা দেখার পর ভেবেছিলাম, আমিও বাঞ্জি জাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতাটা নেব। পরে মত বদলেছি। কিছুই হবে না, জানি। তারপরও একটু ভয় লাগে। সবকিছুরই প্রথম আছে। অকল্যান্ডে বাঞ্জি জাম্পিংয়ে দুর্ঘটনার যদি আমাকে দিয়েই অভিষেক হয়! ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে গিয়ে প্রথম স্বচক্ষে বাঞ্জি জাম্পিং দেখেছিলাম। ভিক্টোরিয়া ফলসের পাশে জিম্বাবুয়ে আর জাম্বিয়ার সীমান্ত নির্দেশক সেতুর ওপর থেকে কোমরে দড়ি বেঁধে লাফিয়ে পড়ছে মানুষ। দেখতে ভালোই লাগে। আমিও তাই দেখেই শান্তি খুঁজেছি।  

আবার অকল্যান্ডে ফিরি। স্কাই সিটিতে ঢোকা যাক। রাস্তা সুনসান, তবে স্কাই সিটিতে কিছু লোকের দেখা মিলল। বেশির ভাগেরই নাক চ্যাপ্টা। অকল্যান্ডে আসার পর থেকেই রাস্তাঘাটে প্রচুর মঙ্গোলিয়ান মুখ দেখছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, বোধহয় চীন-জাপান-কোরিয়া থেকে আসা পর্যটক। এক প্রবাসী বাংলাদেশি ভুলটা ভাঙিয়ে দিয়েছেন। এদের বেশির ভাগই নাকি অকল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা এবং ৮০ শতাংশই ‘মহান চীন’ থেকে আগত। স্কাই সিটির নিচে রেস্টুরেন্টে তাঁদেরই চারজনের একটি দলকে পরদিন সেইলিংয়ে যাওয়া নিয়ে মহা উত্তেজক আলোচনায় মেতে থাকতে দেখলাম।

অকল্যান্ডের আরেক নাম 'সিটি অব সেইলস্‌'

এটা অবশ্য বলার মতো কিছু নয়; বরং অকল্যান্ডে এসে সেইলিং নিয়ে আলোচনা না করলেই সেটিকে বিস্ময় মানা হয়। এ শহরের আরেক নামই যে ‘সিটি অব সেইলস্’। সেটি হয়েছে দারুণ দুটি পোতাশ্রয়ের কল্যাণে। অকল্যান্ডের প্রতীক হয়ে আছে ওই দুটি পোতাশ্রয় (এর চেয়ে হারবার কথাটাই কি বেশি বোধগম্য?)। ওয়াইতেমাতা ও মানুকাও পোতাশ্রয়ের মাঝখানে স্যান্ডউইচের মতো সরু একটা ভূমিখণ্ডের নামই অকল্যান্ড।

সিডনি হারবার ব্রিজের মতো বহুবিজ্ঞাপিত না হলেও অকল্যান্ড হারবার ব্রিজটাও কম সুন্দর নয়। ২০০১ সালে সেটিতে দাঁড়িয়ে বিস্ময়কর এক দৃশ্য দেখেছিলাম। যত দূর চোখ যায়, শুধু বোট আর বোট। পৃথিবীতে মাথাপিছু বোটের সংখ্যার দিক থেকে অকল্যান্ডই এক নম্বরে। দুই বছর আগের এক হিসাবে দেখলাম, একেবারে নিয়ম মেনে তৈরি করা সেইলিং বোটের সংখ্যাই এখানে এক লাখ ৩৫ হাজার। একটু অন্য রকম নৌযান মিলিয়ে সংখ্যাটা দুই লাখের মতো।

একটা শহরেই দুই লাখ বোট, এবার বুঝুন! সংখ্যাটা নিশ্চয়ই এখন আরও বেড়েছে। সেইলিং বোটটা যে এই শহরের বাসিন্দাদের ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ দ্রব্যাদির তালিকাতেই পড়ে, বেশ কয়েকটি বাড়ির গ্যারেজ দেখেই বুঝতে পেরেছি।

কীভাবে? স্থলযান ও জলযানের সহাবস্থানে। গাড়ির পাশেই বোট!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×