দশ বছর অধিনায়কত্ব করেও অতৃপ্ত স্টিভেন ফ্লেমিং
উৎপল শুভ্র
১ এপ্রিল ২০২১
নিছকই কৌতূহল থেকে করা প্রশ্নে স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের উত্তরটা রীতিমতো চমকে দিয়েছিল। দশ বছর টেস্ট ক্যাপ্টেনসি করার পরও তা হারিয়ে মনে এত ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছেন! কই, এর আগে কোথাও পড়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। ২০০৮ সালে ডানেডিনের এডগার ইনডোর সেন্টারে নেওয়া সাক্ষাৎকারটা তাই আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়েছিল। এই কথা যে আগে কখনো বলেননি তাঁর সময়ে সেরা অধিনায়কদের একজন হিসাবে বিবেচিত স্টিভেন ফ্লেমিং।
প্রথম প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০০৮। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: স্টিভেন ফ্লেমিং যে আর নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক নন, এটা আমার মনেই থাকে না। ওভার শেষে বল আর আপনার হাতে আসছে না, কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন এর সঙ্গে?
স্টিভেন ফ্লেমিং: মানিয়ে নেওয়াটা একটু কঠিনই। অধিনায়ক থাকা না-থাকার বড় পার্থক্যটা হলো, আপনি আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তা নন। দশ বছর ক্যাপ্টেনসি করার ফলে যেটা হয়েছে, খেলা দেখতে দেখতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কিছু চিন্তা মাথায় চলে আসে। মনে হয়, ওই ফিল্ডারটাকে ওখানে সরাই। তারপরই মনে হয়, আরে, আমি তো আর ক্যাপ্টেন নই। ক্যাপ্টেন হলে আপনার খেলাটা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে। ক্যাপ্টেন থেকে সাধারণ খেলোয়াড়ে পরিণত হওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা আমার জন্য কঠিনই হচ্ছে।
শুভ্র: একটু নির্ভারও কি লাগছে না? অধিনায়কত্ব তো অনেক চাপও!
ফ্লেমিং: এত বছর ধরে অধিনায়কত্ব করায় আমি ওতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নির্ভার নয়, বরং আমি হতাশ। আমি টেস্ট দলের অধিনায়ক থাকতে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি, অধিনায়ক হিসেবে আমার আরও অবদান রাখার সুযোগ ছিল। টেস্ট ক্যাপ্টেনসি হারানোটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে।
শুভ্র: ইয়ান চ্যাপেলের মতো অনেকে মনে করেন, চার-পাঁচ বছরের বেশি কারও অধিনায়কত্ব করাই উচিত নয়। আর আপনি দশ বছর ক্যাপ্টেনসি করার পরও এ কথা বলছেন!
ফ্লেমিং: এক দিক থেকে চ্যাপেলের কথাটা হয়তো ঠিক। তবে আমি আমার প্রথম ছয় বছর কোনো ক্যাপ্টেনসি করেছি বলে মনে করি না। ক্যাপ্টেনসি যা করেছি, তা শেষ তিন-চার বছর। এর আগের সময়টা আমি অধিনায়ক ছিলাম আর কেউ ছিল না বলে। আমি ভাগ্যবান, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য লম্বা একটা সময় পেয়েছি। তবে অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিংকে বিচার করতে আমি শেষ তিন-চার বছরকেই বিবেচনায় নিতে বলি।
এই যে আপনার প্রশ্ন শুনেই বুঝতে পারছি, ইন্টারভিউ করার আগে আপনি অনেক হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। হোমওয়ার্ক করে এলে ইন্টারভিউ ভালো হবেই। আর না করে এলে ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। ক্রিকেটেও একই রকম।
শুভ্র: ওই সময়টায় আপনাকে অনেকে বিশ্বের সেরা অধিনায়কও বলেছে। আপনিই ভালো বলতে পারবেন, ক্রিকেট অধিনায়কের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
ফ্লেমিং: অবশ্যই খেলোয়াড়দের ম্যানেজ করা। ওদের ভালোমন্দ, ভবিষ্যৎ এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কাজের কঠিনতম অংশ এটাই।
শুভ্র: তার মানে লোকে শুধু মাঠের ক্যাপ্টেনসিটা দেখলেও মাঠের বাইরের লিডারশিপ অংশটা হয়তো এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্লেমিং: মাঠের বাইরে কাজ আরও বেশি। আমি মাঠের বাইরে অনেক কাজ করতাম, তাতে মাঠে নামার পর কী করতে চাই, পরিষ্কার ধারণা থাকত। মাঠে শান্ত-সুস্থির থাকতে পারতাম। এই যে আপনার প্রশ্ন শুনেই বুঝতে পারছি, ইন্টারভিউ করার আগে আপনি অনেক হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। হোমওয়ার্ক করে এলে ইন্টারভিউ ভালো হবেই। আর না করে এলে ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। ক্রিকেটেও একই রকম। যদি প্রস্তুতি থাকে, তা হলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি।
শুভ্র: অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে আনন্দদায়ক স্মৃতি কী? সবচেয়ে হতাশারটাও শুনতে চাই।
ফ্লেমিং: সবচেয়ে বড় হতাশা, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোনো সিরিজ জিততে না পারা। কখনো বিশ্বকাপ ফাইনালে যেতে না পারা। আর আনন্দের কথা বললে অনেক ছোট ছোট ব্যাপারও অনেক সময় দারুণ আনন্দ দেয়। হয়তো আপনি যা প্ল্যান করলেন, তা কাজে লেগে গেল। এর মতো আনন্দ আর হয় না। অস্ট্রেলিয়ায় ২০০১-০২ সিরিজে যে আনন্দ আমি অনেকবার পেয়েছি। শেষ পর্যন্ত আমরা সিরিজ জিততে পারিনি। কিন্তু গ্রেট কিছু খেলোয়াড়কে ওদের ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো চাপে ফেলতে পেরেছি। এটা খুব আনন্দময় স্মৃতি।
শুভ্র: সর্বশেষ ২০০১ সালে যখন আপনার ইন্টারভিউ করেছিলাম, স্টিভ ওয়াহর অধিনায়কত্ব নিয়ে আপনাকে প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখেছিলাম। গত দুই-তিন দশকে স্টিভ ওয়াহই কি আপনার কাছে অধিনায়ক হিসেবে আদর্শতম?
ফ্লেমিং: অধিনায়ক হিসেবে মার্টিন ক্রো ও স্টিভ ওয়াহই আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন। মার্টিন ক্রোকে আমি অসাধারণ মনে করি, কারণ তিনি নতুন নতুন জিনিস ভাবতেন। তাঁর দলটা এমন কিছু ছিল না, অথচ সেই দলের পারফরম্যান্সই তিনি অনেক ওপরে তুলে নিয়েছিলেন। স্টিভেন ওয়াহর চ্যালেঞ্জ ছিল অন্য, অনেক গ্রেট খেলোয়াড়কে ম্যানেজ করতে হয়েছে তাঁকে। দলের হাই পারফরম্যান্সটা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ তো ছিলই।
শুভ্র: গত বিশ্বকাপের (২০০৭) সেমিফাইনালে হারার পর বারবার সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার কারণ হিসেবে আপনি বলেছিলেন, নিউজিল্যান্ড যথেষ্ট গ্রেট খেলোয়াড় তৈরি করতে পারেনি। আমার প্রশ্ন এটাই—আমরা যাদের ফ্লেয়ার প্লেয়ার বলি, যাদের টানে মাঠে দর্শক ছুটে আসে, নিউজিল্যান্ডে এমন খেলোয়াড় এত কম কেন? হ্যাডলি-ক্রোর পর ক্রিস কেয়ার্নস, শেন বন্ড আর হয়তো আপনি...আর কারও কথা তো মনে করতে পারি না। কারণটা কি ক্রিকেটের বাইরের কিছু? জাতিগত বৈশিষ্ট্য জাতীয় কিছু?
ফ্লেমিং: হতে পারে। কোচিং সিস্টেমটাও একটা কারণ হতে পারে। আমি বলব, নিউজিল্যান্ডের কম জনসংখ্যাও (৪২ লাখ) বড় কারণ। এত কম মানুষের মধ্য থেকে বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি হওয়াটা সহজ নয়। বাংলাদেশ এত জনসংখ্যা নিয়েও তো তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় এর অভাব নেই। কারণ হয়তো ওখানকার কন্ডিশন। দেখেন না, নিউজিল্যান্ডে এখন গ্রীষ্ম, তারপরও আমাকে ইনডোরে প্র্যাকটিস করতে হচ্ছে। আমাদের কন্ডিশন এমন যে, খেলোয়াড়দের ইচ্ছেমতো বাইরে বাইরে খেলে ফ্লেয়ার প্লেয়ার হওয়ার সুযোগ খুব কম। বেশির ভাগ সময়ই আমাদের ইনডোরে প্র্যাকটিস করতে হয়। হয়তো আমরা মেনেও নিয়েছি যে, নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা এমনই হবে।
টেন্ডুলকারের ওপর ছিল ভারতীয় জনগণের প্রত্যাশার চাপ। লারার চাপ ছিল পুরো দলের ভার বয়ে বেড়ানোর। পন্টিংয়ের ওপর চাপ সফলতম ক্রিকেট ইতিহাস ধরে রাখার। তিনজনই সব চাপ সামলে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করেছে। গ্রেট প্লেয়ারস্।
শুভ্র: আদর্শ ব্যাটসম্যান হিসেবে যদি কারও নাম বলতে বলি।
ফ্লেমিং: আমি তিনটি নাম বলব। লারা, পন্টিং ও টেন্ডুলকার। কারণ ওরা তিনজনই চাপের মধ্যে নিয়মিত পারফর্ম করেছে। টেন্ডুলকার তো সব সময়ই চাপে থাকে। সমর্থকদের চাপ, ভারতীয় জনগণের প্রত্যাশার চাপ। লারার চাপ ছিল পুরো দলের ভার বয়ে বেড়ানোর। পন্টিংয়ের ওপর চাপ সফলতম ক্রিকেট ইতিহাস ধরে রাখার। তিনজনই সব চাপ সামলে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করেছে। গ্রেট প্লেয়ারস!
শুভ্র: কোনো ব্যাটসম্যানের নির্দিষ্ট কোনো শট, যা দেখে মনে হয়েছে, ‘আহা, আমিও যদি অমন খেলতে পারতাম!’
ফ্লেমিং: নিজে বাঁহাতি বলে লারার কথাই বলব। যদিও দুজনই বাঁহাতি, লারার সঙ্গে আমার এটুকুই মিল (হাসি)। যেভাবে ও অফ সাইডে শট খেলে, সো ল্যাঙ্গুইড অ্যান্ড লুজ! যেভাবে স্পিনারদের ওভার দ্য টপ খেলে! আমার ব্যাটিংয়ে অমন রাজকীয় সৌন্দর্য কখনোই ছিল না।
শুভ্র: পন্টিং-টেন্ডুলকার তো প্রথাসিদ্ধতার খুব কাছাকাছি। কিন্তু লারা তো একেবারেই অন্য রকম। বয়কট যেমন বলেছিলেন, লারা একটা ‘ফ্রিক’!
ফ্লেমিং: লারা অনেক কিছুই করেছে, যা কোচিং ম্যানুয়ালকে রীতিমতো বুড়ো আঙুল দেখানো। খেলাটার মজাই এখানে। মালিঙ্গাকে দেখুন, মুরালিকে। ওরা প্রমাণ করেছে, প্রথাসিদ্ধ না হয়েও আপনি সফল হতে পারেন। ওসব দেশে এসব উৎসাহিত করা হয়। আর এখানে কেউ অন্য রকম হলে আমরা তাকে পন্টিং বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করি। সহজাত খেলা খেলতে দিই না। কোচিং ম্যানুয়ালটাই বড় হয়ে ওঠে।
শুভ্র: হাবিবুল বাশারের সঙ্গে যে আপনার অনেক মিল, এটা খেয়াল করেছেন? আপনার মতো হাবিবুলও ওয়ানডে ক্যাপ্টেনসি ছেড়ে শুধু খেলোয়াড় হিসেবে ওয়ানডে খেলতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন টেস্ট অধিনায়ক থাকতে। আপনার মতোই পারেনি। আরেকটা বড় মিল, হাফ সেঞ্চুরিকে সেঞ্চুরি বানানোর অক্ষমতা। টেস্টে ওর ৩টি সেঞ্চুরি, আর ২৪টি হাফ সেঞ্চুরি। আপনারও যেহেতু এই সমস্যা, আপনি নিশ্চয়ই ওকে সাহায্য করতে পারবেন।
ফ্লেমিং: এই সমস্যার নির্দিষ্ট একটা কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এটাই সবচেয়ে হতাশার দিক। প্রতিটি ইনিংসেই ভিন্ন কারণ থাকে। কখনো ভালো বলে আউট, কখনো দ্রুত সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোর তাড়ায়। আমি জানি না বাশারের ঘটনা কী। হয়তো এমন দলে খেলছে যেখানে চাপ বেশি। অথবা এমন দলে, যাতে ৬০-৭০কেই যথেষ্ট ভালো মনে করা হয়। ৬০-৭০ করলেই পরের দুই-তিন টেস্টে দলে থাকব, ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আমারও এমন একটা চিন্তা ছিল।
শুভ্র: এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
ফ্লেমিং: টি-টোয়েন্টির আবির্ভাবের পর খেলাটা ম্যানেজ করা। খেলোয়াড়রা টাকা পাচ্ছে, বোর্ডও টাকা কামাচ্ছে। কিন্তু খেলোয়াড়দের টানা খেলার ব্যাপারটাও তো মাথায় রাখতে হবে।
শুভ্র: টি-টোয়েন্টি কি ওয়ানডের জন্য হুমকি?
ফ্লেমিং: অবশ্যই। অনেক দিনই দর্শক আর আগের মতো ওয়ানডে দেখতে যাচ্ছে না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নতুন সঞ্জীবনী। আমার তো মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেট আর টি-টোয়েন্টিই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ।