`দ্য ডেমন`-এর হাত ধরে চলুন ঘুরে আসি ক্রিকেটের রথী-মহারথীদের আড্ডা

উৎপল শুভ্র

৩১ মার্চ ২০২১

`দ্য ডেমন`-এর  হাত ধরে চলুন ঘুরে আসি ক্রিকেটের রথী-মহারথীদের আড্ডা

ফ্রেড স্পফোর্থ। ক্রিকেট সত্যিকারের প্রথম ফাস্ট বোলার চিনেছিল যাঁর সৌজন্যে। ছবি: উইজডেন।

`দ্য ডেমন` ডাকনামই চিনিয়ে দিচ্ছে, ব্যাটসম্যানদের বুকে কেমন ভয়ের কাঁপন তুলতেন তিনি! অনেক অনেক বছর আগে আজকের এই দিনে টেস্ট ক্রিকেটে আবির্ভাব ``দ্য ডেমন` ফ্রেড স্পফোর্থের। অ্যাশেজের জন্মেও যাঁর পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। স্পফোর্থের টেস্ট অভিষেকের দিনে তাঁর হাত ধরে ক্রিকেটের শুরুর দিকের কীর্তিমানদের কল্পিত আড্ডা থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়!

স্বর্গে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটা বড় সুন্দর। পশ্চিমাকাশে সূর্যটা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। যেন ডুববে কি ডুববে না সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তারপর একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডুবতে শুরু করে। সূর্য অর্ধেকটা অদৃশ্য হয়ে যেতে না- যেতেই মেঘের ঘােমটা খুলে উকি দেয় চাঁদ। পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ। স্বর্গে অমাবস্যা বলে কিছু নেই। রাতের আকাশে ফুল হয়ে ফুটে থাকে অসংখ্য তারা। তার ঠিক মাঝখানে সাদা সিরামিকের প্লেটের মতাে বিশাল এক বৃত্তাকার চাঁদ। স্বর্গে সর্বত্রই পূর্ণিমা।

স্বর্গে তাই অন্ধকার বলেও কিছু নেই। দিনে নরম রােদ ছড়ায় সূর্য, রাতে চরাচর ভেসে যায় চাঁদের মায়াবী আলােয় । সেই মায়াবী আলােতেই আজ আড্ডা বসেছে মাঠে। নতুন অতিথিও আছে। আগের দিন ফ্রেড স্পফোর্থের কথা উঠতেই ডন ব্র্যাডম্যান আগ্রহভরে জানতে চাইছিলেন তার কথা। স্পফোর্থ নামটা শােনার পর থেকেই রোমাঞ্চিত বােধ করছেন। বাউরালে বাড়ির পেছনের আঙিনায় একা একা কাল্পনিক কত অ্যাশেজ খেলেছেন। খেলােয়াড়ি জীবনে খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের বিপক্ষেও। কিন্তু অ্যাশেজই হয়ে থেকেছে সবচেয়ে বড়। সেই অ্যাশেজের জন্ম যার কারণে, এখানে আসার পর তাঁর সঙ্গে কেন যেন দেখাই হয়নি। আলফ্রেড শ কথা দিয়েছিলেন, পরদিন আড্ডায় নিয়ে আসবেন স্পফোর্থকে।

ডন ব্র্যাডম্যানই সবার শেষে এলেন। এসেই খুঁজলেন ফ্রেড স্পফোর্থকে। ওই তাে ডব্লিউ জি.গ্রেসের পাশে বসে আছেন। ছবিতে যেমন দেখেছেন, বিশাল গোঁফজোড়া এখনাে তেমনই আছে। সেদিন বাকিদের কথা শুনে মনে হয়েছিল, ডব্লিউ জি আর স্পফোর্থ জন্মের শত্রু। অথচ দুজন তাে দেখি দিব্যি হাসিমুখে গল্প করছেন।

ক্রিকেটের অমর বুড়ো, ডব্লিউ জি গ্রেস। ছবি: গেটি ইমেজেস

ব্র্যাডম্যানকে দেখেই হইহই করে উঠলেন শ, ‘দ্য ডেমনকে দেখতে চেয়েছিলে, ওকে নিয়ে এসেছি। তােমার জন্য আরও সারপ্রাইজ আছে। আরও দুজনকে নিয়ে এসেছি আজ। দেখি তাে, চিনতে পারাে কি না। ব্র্যাডম্যান একে একে সবার মুখের দিকে তাকালেন। আগের দিনের আড্ডায় যারা ছিলেন, সবাই আছেন। নতুন কারা? ওই তাে! স্পফোর্থের পাশেই নতুন দুজনকে দেখা যাচ্ছে। দেখেই চিনে ফেললেন ব্র্যাডম্যান। ক্লেম হিলকে তাে পৃথিবীতে থাকতেই দেখেছেন। নামটাও শুনতে হয়েছে অনেকবারই। শেফিল্ড শিল্ডে হিলের সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটা যে তিনিই ভেঙেছিলেন। ভিক্টর ট্রাম্পারের সঙ্গে পৃথিবীতে দেখা হয়নি। ট্রাম্পার যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স সাত ছুঁই-ছুঁই। বােঝার বয়স হয়নি। তবে সিডনিতে কোনাে একজন ক্রিকেটার মারা গেছেন, তাঁর শেষ যাত্রা ছিল লােকে লােকারণ্য, এসব শুনেছেন বলে আবছা মনে পড়ে। ট্রাম্পারের সঙ্গে পরিচয় ছবিতে। আর খেলা শুরু করার পর থেকে তাে সবার মুখে মুখে শুনেছেন ট্রাম্পারের নাম। তাঁর মতাে ব্যাটসম্যান নাকি কেউ দেখেনি, আর দেখবেও না কোনাে দিন । নিজে খেলতে শুরু করার পর মনে প্রশ্ন জেগেছে, রেকর্ড তাে এমন কিছু নয়। ৪৮ টেস্টে ৩৯.০৪ গড়ে ৩১৬৩ রান। তাহলে কেন ট্রাম্পারকে নিয়ে এত মাতামাতি? যাকেই জিজ্ঞেস করেছেন, উত্তর পেয়েছেন একটাই—'রান-সেঞ্চুরিতে ট্রাম্পারকে বােঝা যাবে না।'

ভিক্টর ট্রাম্পার। রান-গড়ের সাধ্য কি তাঁকে বোঝায়! ছবি: জর্জ বেলডাম

ব্র্যাডম্যানকে দেখে সস্নেহ হাসি ফুটল ট্রাম্পার আর হিলের মুখে। হিল মজা করলেন, "কী ডন, শ বলল তুমি নাকি 'দ্য ডেমন'কে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছ?"

ফ্রেড স্পফোর্থ কৌতুকমাখা চোখে ব্র্যাডম্যানের দিকে তাকিয়ে আছেন। ব্র্যাডম্যানের টেস্ট অভিষেকের বছর দুয়েক আগে স্বর্গে চলে এসেছেন, পৃথিবীতে তাই তাঁর ব্যাটিং দেখার সুযােগ হয়নি। তবে স্বর্গে আসার পর বড় পর্দায় ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং দেখতে দেখতে অনেকবারই ভেবেছেন, ছোঁড়াটার বিপক্ষে বােলিং করতে পারলে নিজের দৌড়টা বুঝতে পারতেন।

ব্র্যাডম্যানের দিকে চোখ নাচিয়ে ডব্লিউ জি বললেন, 'সেদিন ওদের কথা শুনে তােমার মনে হয়ে থাকতে পারে, ফ্রেড বােধ হয় আমার দুচোখের বিষ। তা পৃথিবীতে থাকার সময় ওকে অপছন্দই করতাম। এমন জ্বালিয়েছে আমাদের। তবে মনে মনে শ্রদ্ধা তাে ছিলই। বল হাতে ও ছিল সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে গবেষণাটা বলতে পারাে ও-ই প্রথম শুরু করেছিল। আর জোরে বল যেটা করত, আমার তাে মনে হয় সেটির গতি হ্যারল্ড লারউডের চেয়ে কম ছিল না। আমি চাই একদিন স্পফোর্থকে খেলুক ডন, তাহলে তুলনা করতে পারবে।'

হ্যারল্ড লারউড নামটা ব্র্যাডম্যানকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল বডিলাইন সিরিজে। সেই আগুনে বাতাবরণে। ইংল্যান্ড ম্যানেজার পেলহাম ওয়ার্নার অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে এসেছেন। অধিনায়ক বিল উডফুল দরজাই খুলতে চাইছিলেন না। পরে তার মুখের ওপর বলে দেন, 'মিস্টার, মাঠে দুটি দল আছে। এর মধ্যে একটিই ক্রিকেট খেলছে।' কথাটা কীভাবে মিডিয়ায় চলে গিয়েছিল, তা একটা রহস্য বটে। জ্যাক ফিঙ্গলটন তখনই সাংবাদিক। তাঁর দিকেই আঙুল তুলেছিল সবাই। আসল সত্যিটা জানেন শুধু ব্র্যাডম্যান নিজে। মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।

অ্যাশেজের জন্মকাহিনিটা শােনার জন্য ব্র্যাডম্যানের তর সইছে না। স্পফোর্থ বলতেও যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে শ বললেন, 'ফ্রেডকে আমরা এর বছর চারেক আগেই চিনেছিলাম। সেটা আগে শুনে নাও। ১৮৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ানরা ইংল্যান্ড সফরে এসেছিল। সেবার কেন যেন টেস্ট ম্যাচ হয়নি। ওরা ইংল্যান্ডের বিভিন্ন দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলেছিল। তখন তাে আর সবকিছু এখনকার মতাে গােছানাে ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিকও নয়। অস্ট্রেলিয়ানদের ওই সফরই যেমন আয়ােজন করেছিলেন জন কনওয়ে। উনি ছিলেন সাংবাদিক। অস্ট্রেলিয়ান খেলােয়াড়েরা ইংল্যান্ডে আসতে প্রত্যেকে ৫০ পাউন্ড করে চাঁদা দিয়েছিল। আশা ছিল, গেটমানি-টানির ভাগ থেকে ওই টাকা তােলার পরও কিছু লাভ থাকবে। ঠিক বলছি তাে ফ্রেড?'

ফ্রেড স্পফোর্থ বললেন, 'একদম ঠিক। এখনাে খুঁটিনাটি সব মনে আছে। দেখে একটু আশ্চর্যই হচ্ছি। আমাদের সময়ে ট্যুরগুলাে তাে এভাবেই হতাে।'

শ এবার মূল প্রসঙ্গে এলেন, 'ওই সফরেই এমসিসির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ানদের ম্যাচ। এই ফ্রেড স্পফোর্থের কারণেই সেই ম্যাচ এক দিনেই শেষ! প্রথম ইনিংসে এমসিসি ৩৩ রানে অলআউট। ৪ রান দিয়ে ফ্রেড ৬ উইকেট নিল, হ্যাটট্রিকও করল। অস্ট্রেলিয়ানরাও বেশি করেনি, ৪১ রানে অলআউট।' স্পফোর্থ বললেন, সেটা তাে আপনার কারণে। ১০ রানে আপনি ৫টা নিয়েছিলেন।'

'কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা মাত্র ১৯ রানেই অলআউট! কী লজ্জার ব্যাপার! এবার ফ্রেডের ১৬ রানে ৪ উইকেট। অস্ট্রেলিয়ানদের আমরা মাত্র ১২ রানের টার্গেট দিতে পারলাম, ১ উইকেট হারিয়েই ওরা তা করে ফেলল।'

চার্লস ব্যানারম্যানও ওই ম্যাচে খেলেছেন। ডব্লিউ জির দিকে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন, 'কী ডক, মনে আছে তাে ম্যাচটার কথা? প্রথম ইনিংসে তুমি প্রথম বলেই চার মেরেছিলে। পরের বলেই আউট! আর দ্বিতীয় ইনিংসে তােমাকে শূন্য রানে বােল্ড করে দেওয়ার পর শূন্যে লাফিয়ে বােল্ড-বােল্ড বলে স্পফোর্থের সে কি চিৎকার! ইনিংস শেষে ড্রেসিংরুমে বুকে চাপড় মারতে মারতে বলতে লাগল, বলাে, আমি কি ডেমন নই? আমি কি ডেমন নই? ও আসলে নিজেই নিজেকে ব্যাপটাইজ করেছে। দ্য ডেমন নামটা নিজেই দিয়েছে।'

চার্লস ব্যানারম্যান। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলটি খেলেছেন, প্রথম রান ও প্রথম সেঞ্চুরিও তাঁর। ছবি: গেটি ইমেজেস

ব্র্যাডম্যান মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। অনেক বছর ধরে মনে জমিয়ে রাখা একটা কৌতুহল মেটানাের সুযােগটাও নিলেন, 'আপনাদের সময়কার বােলারদের তাে ভয়ংকর সব নিকনেম ছিল। "দ্য ডেমন", "দ্য টেরর", "দ্য ডেভিল"। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ভয় পাওয়াতে এমন নাম দেওয়া হতাে নাকি?'

উত্তরটা দিলেন লােহম্যান, তুমি যে তিনটি নাম বললে, তিনজনই অস্ট্রেলিয়ান। অস্ট্রেলিয়ায় এমন একটা চল ছিল। তবে শুধু নামে নয়, বােলারও কিন্তু ওরা ভয়ংকরই ছিল। "দ্য টেরর" নাম ছিল চার্লি টার্নারের । সবচেয়ে কম ইনিংসে টেস্টে ১০০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এখনাে ওর। আমি ১৬ টেস্টে নিয়েছিলাম। ও ১৭ টেস্টে, তবে আমার চেয়ে এক ইনিংসে কম বােলিং করে। "দ্য ডেভিল" বলা হতাে হ্যারি বয়েলকে। যে ম্যাচটির কথা হচ্ছিল, সেটির দ্বিতীয় ইনিংসে ও ৩ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিল। যে টেস্টে অ্যাশেজের জন্ম, সেটিতে ইংল্যান্ডের শেষ উইকেটটিও নিয়েছিল বয়েল।

ডব্লিউ জি এমসিসির ওই ম্যাচটার কথা মনে করে আপন মনে হাসছিলেন। হাসছিলেন আসলে ওই ম্যাচের পর পাঞ্চ পত্রিকায় ছাপা হওয়া প্যারোডি কবিতাটার কথা মনে করে-

The Australians came down like a wolf on the fold,

The Marylebone cracks for a trifle were bowled;

Our Grace before dinner was very soon done,

And Grace after dinner did not get a run.

ফ্রেড স্পফোর্থের চোখে ভাসছিল ক্রিকেট মাঠের সেই দিনগুলাে। 'অ্যাশেজের গল্প তাে আমার বলার দরকার নেই। সবাই তা জানে। ডন, তুমিও তাে জানাে। আমি বরং আমার একটা দুঃখের কথা বলে নিই। দুঃখ আসলে একটা নয়, দুইটা। পরে যেটি ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচের মর্যাদা পেয়েছে, সেটিতে আমি খেলিনি। ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচেও না', বলে চোখ টিপলেন, 'নইলে কি আর ডব্লিউ জি সেঞ্চুরি পায়?'

ডব্লিউ জি কথাটা গায়ে না মেখে বললেন, 'প্রথম টেস্টে আমি খেলতে পারিনি নানা ঝামেলায় সেবার অস্ট্রেলিয়া যাইনি বলে। তখন কি আর জানি, ওটা এমন ইতিহাস হয়ে যাবে! তবে তুমি তাে গোয়ার্তুমি করে খেলােনি!'

স্পফোর্থ হাসলেন, 'তা বলতে পারো। আমার বন্ধু বিলি মারডকের বদলে ভিক্টোরিয়ানরা ওদের উইকেটকিপার জ্যাক ব্ল্যাকহামকে দলে নেওয়ায় রাগ করেই খেলিনি। কদিন পরই দ্বিতীয় টেস্টে অবশ্য খেলেছি। বিলিও খেলেছে। এখন মানতে দ্বিধা নেই, বিলি ব্যাটসম্যান হিসেবে দুর্দান্ত হতে পারে, তবে কিপার হিসেবে ব্ল্যাকহামই ওর চেয়ে ভালাে ছিল। দ্বিতীয় টেস্টটায় শকে যে স্টাম্পিংটা করল, এখনাে তা চোখে লেগে আছে। ওই সময়ের আর কোনাে কিপার তা পারত বলে মনে হয় না। বিলি কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে কিছুক্ষণ উইকেটকিপিং করেছিল। টেস্টের শেষ দিনে ব্ল্যাকহাম সানস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বাইরে চলে যাওয়ার সময়টায়।'

স্পফোর্থের এই ক্ষোভের কথা ডব্লিউ জি, শ, লােহম্যান সবারই জানা। থ্রােয়ারদের দৌরাত্ম্য চলছিল দশকজুড়েই। স্পফোর্থ সব সময়ই এর বিরুদ্ধে সােচ্চার ছিলেন। ইংল্যান্ডের স্পাের্টিং লাইফ পত্রিকায় একটা চিঠিও লিখেছিলেন ১৮৯৭ সালে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ওটা তাঁর শেষ বছর।

ব্র্যাডম্যান জানতে চাইলেন, 'ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্টে খেলেননি কেন? আপনার বন্ধু বিলি মারডকই তাে তখন ক্যাপ্টেন।

'বলছি। ওই টেস্ট মিস করাটা আমার দোষে নয়। বলতে পারাে, দুর্ভাগ্য। ওই টেস্টের ১৫/১৬ দিন আগে আমরা স্কারবােরাের সঙ্গে একটা ম্যাচ খেলেছিলাম। ওই ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সময় জোসেফ ফ্রাঙ্ক নামে এক ফাস্ট বােলারের বলে আমার আঙুল ভেঙে যায়। খেলায় এমন হতেই পারে। কিন্তু ওই বদমাশটা ছিল থ্রোয়ার। পরিষ্কার বল ছুড়ত। আমার এমন রাগ হয়েছিল যে একবার মনে হয়েছিল, মাঠেই ওর গলা টিপে ধরি! ওর জন্যই আমার ওভাল টেস্টে খেলা হলাে না। অথচ আমি তখন কী দারুণ ফর্মে। ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই ৯ উইকেট নিয়েছিলাম।'

স্পফোর্থের এই ক্ষোভের কথা ডব্লিউ জি, শ, লােহম্যান সবারই জানা। থ্রােয়ারদের দৌরাত্ম্য চলছিল দশকজুড়েই। স্পফোর্থ সব সময়ই এর বিরুদ্ধে সােচ্চার ছিলেন। ইংল্যান্ডের স্পাের্টিং লাইফ পত্রিকায় একটা চিঠিও লিখেছিলেন ১৮৯৭ সালে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ওটা তাঁর শেষ বছর।

কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার তােয়াক্কা না করে স্পফোর্থ ওই চিঠিতে পরিষ্কার বলে দেন, ইংল্যান্ডের সব কাউন্টি দলেই কোনাে না কোনাে থ্রোয়ার আছে। নিজের দেশকেও ছাড় দেননি। অস্ট্রেলিয়া দলের সব বােলারের অ্যাকশনেই সমস্যা আছে ঘােষণা করে নির্দিষ্টভাবে টম ম্যাককিবিনের নামও উল্লেখ করেন। এটাও লেখেন যে বিদ্যমান আইনে তার খেলার কোনাে অধিকার থাকতে পারে না। আম্পায়ারদের যে কিছু করার সাহস নেই, সেটাও বলতে ছাড়েননি।

ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরাতে তাঁর সময়ের অন্য অনেকের মতো ঢিল ছুড়তে হতো না স্পফোর্থকে। ছবি: গেটি ইমেজেস

সঙ্গে একটা সুপারিশও করেছিলেন। সব কাউন্টি অধিনায়ককে নিয়ে একটা কমিটি করে সেটিকে ক্ষমতা দিতে হবে। বাতলে দিয়েছিলেন শাস্তিও—প্রথম অপরাধের জন্য এক সপ্তাহ সাসপেন্ড, দ্বিতীয় অপরাধের জন্য জরিমানাসহ এক সপ্তাহ সাসপেন্ড, তৃতীয়বার একই কাজ করে পুরাে মৌসুমের জন্য সাসপেন্ড।

ম্যাককিবিন অবশ্য বহাল তবিয়তেই খেলে গেছেন। থ্রোয়িংয়ের জন্য কোনাে আম্পায়ার কখনাে তাঁকে 'কল' ও করেননি। থ্রোয়ারদের কথা ওঠায় অস্ট্রেলিয়ার আর্নি জোন্সের কথা মনে পড়ল সিবি ফ্রাইয়ের। বলে দুর্দান্ত গতি ছিল। একটি-দুটি স্পেলে ওর চেয়েও গতিময় কাউকে কাউকে দেখেছেন। তবে টানা জোরে বল করে যাওয়ার কথা বললে জোন্সই তার খেলা দ্রুততম বােলার। কিন্তু ওর বেশি জোর দিয়ে করা বলগুলােয় নির্ঘাত ঝামেলা ছিল।

আর্নি জোন্সের কথা মনে হলে অবশ্য বােলিংয়ে গতির ঝড়ের চেয়ে ফ্রাইয়ের বেশি মনে পড়ে সেই মজার গল্পটা। ১৮৯৬ সালের ইংল্যান্ড সফরে শেফিল্ড একাদশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ানদের খেলা। ব্যাটিং করছেন ডব্লিউ জি গ্রেস। আর্নি জোন্সের বল তাঁর দাড়ির মধ্য দিয়ে চলে গেল ।

ডক্টর রেগেমেগে জানতে চান, 'এটা কী হচ্ছে, জোন্স?'

বিব্রত জোন্স উত্তর দেন, 'সরি, ডক্টর, শি স্লিপড।'

ফ্রাই বললেন, 'শুনলাম, এখন নাকি চাকিং ধরতে কী সব ডিগ্রি-টিগ্রির হিসাব বেরিয়েছে। শ্রীলঙ্কার যে ছেলেটার টেস্টে ৮০০ উইকেট, ওকে তাে চাকিংয়ের জন্য "কল" করেছিল আম্পায়াররা। ল্যাবরেটরিতে টেস্ট হয়েছে। মুরালিধরন না নামটা?'

ডব্লিউ জি কখনােই রসিকতা করার সুযােগ ছাড়েন না, ভালােই তাে! আমরা শুধু মাঠেই টেস্ট খেলতাম। এখন তাহলে ল্যাবরেটরিতেও টেস্ট হচ্ছে।

নিজের রসিকতায় নিজেই কিছুক্ষণ হাে হাে হাসলেন। তারপর মুখটা একটু মলিন বলে বললেন, ‘ফ্রেডের মতাে আমারও একটা দুঃখ আছে। প্রথম টেস্ট খেলতে না পারা নিয়ে অতটা নয়। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, আমার সেরা সময়টায় টেস্ট খেলতে পারলাম না। অভিষেকই তাে হলাে ৩২ বছর বয়সে। তারপরও ১৯ বছর খেলেছি। ১৮৯৯ সালের সিরিজটা পুরােটাই খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নটিংহ্যামে প্রথম টেস্টের সময়ই বুঝে ফেললাম, শরীর আর টানতে পারছে না। মাঠ ছাড়ার সময়ই স্ট্যানলি জ্যাকসনকে বলেছিলাম, "জ্যাকার, আর পারছি না। আমার যাবার সময় হয়েছে। সমস্যাটা বেশি হচ্ছিল ফিল্ডিংয়ে । যত দৌড়াই, বল মনে হয় আরও দূরে চলে যায়। ওই টেস্টে তাে তােমাদের অনেকেই ছিলে। আমার দলে রঞ্জি, ফ্রাই, রােডস; অস্ট্রেলিয়া দলে হিল-ট্রাম্পার। রােডস- ট্রাম্পার, তােমাদের ওই টেস্টেই ডেব্যু হলাে না?

ট্রাম্পার উৎকর্ণ হয়ে শুনছিলেন। অস্ট্রেলিয়া দলে প্রথম, ইংল্যান্ডেও সেই প্রথম। ওই সফরের সবকিছুই তাই পরিষ্কার মনে আছে। সিবি ফ্রাইয়ের সঙ্গে ডব্লিউ জি যখন ওপেন করতে নামছিলেন, চোখ সরাতে পারছিলেন না। ডব্লিউ জিকে নিয়ে এত কিছু শুনেছেন, আর আজ তাঁর বিপক্ষেই খেলছেন!

মনটা অবশ্য খুব খারাপ ছিল। টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম ইনিংসেই কিনা ডাক মেরে বসেছেন! ট্যুরটা শুরুই হয়েছিল শূন্য দিয়ে। এসেক্সের বিপক্ষে ম্যাচে কোনাে রান করার আগেই বােল্ড হয়ে গেলেন। জীবনের প্রথম টেস্ট ইনিংসেও বােল্ড। জ্যাক হিয়ার্নের বলটা বুঝতেই পারেননি। হিয়ার্ন ওই সিরিজে ভালােই ভুগিয়েছিল। হ্যাটট্রিকও করেছিল তৃতীয় টেস্টে। স্পফোর্থ আর লােহম্যানকে দেখে মনে পড়ল, এই দুজনেরও টেস্টে হ্যাটট্রিক আছে। টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিকের প্রথম কীর্তিটা স্পফোর্থেরই।

ট্রাম্পারের সংবিৎ ফিরল ডব্লিউ জির কথায়, 'হেই ভিক, লর্ডসে ওই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের কথা মনে আছে তাে?'

ট্রাম্পার হাসলেন। ডব্লিউ জি কোন ঘটনার কথা বলছেন, বুঝতে একটুও সমস্যা হলাে না। এটা কি ভােলা যায়। প্রথম টেস্টে ব্যর্থতার দুঃখ ভুলেছিলেন সেঞ্চুরি করে। ক্লেম হিলও সেঞ্চুরি করেছিলেন। দুজনই ১৩৫, তবে তিনি ছিলেন অপরাজিত। দিনের খেলা শেষে অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমের দরজায় ডব্লিউ জি গ্রেস। তাঁকে ডেকে বললেন, 'যে ব্যাটটা দিয়ে খেলেছ, আমাকে তা দিয়ে দাও। অটোগ্রাফ দিয়ে দিয়াে।' ডব্লিউ জিও একটা ব্যাট নিয়ে এসেছিলেন। সেটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, 'ফ্রম টুডেস চ্যাম্পিয়ন টু দ্য চ্যাম্পিয়ন অব দ্য ফিউচার।' ব্যাটটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন ট্রাম্পার । এত দিন পর সেটি মনে করে বললেন, 'আমার জন্য ওটা ছিল বড় এক উপহার।'

তােমার ব্যাটটাও আমার জন্য তা-ই ছিল। আরেকটা কথা কি মনে আছে, চতুর্থ ও পঞ্চম টেস্টের মাঝখানে আমি তােমাদের বিপক্ষে আরেকটা ম্যাচ খেলেছিলাম। ডব্লিউ জি গ্রেস একাদশ বনাম অস্ট্রেলিয়ানস। ওই ম্যাচে আমি কিন্তু তােমাকে বােল্ড করেছিলাম, ২৫ রানের বেশি করতে দিইনি।'

রঞ্জি গুনগুন করে গান গাইছিলেন। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিক খুব পছন্দ। গাইতে গেলেই অবশ্য ডব্লিউ জি বেসুরাে গলায় তাল মেলাতে যান। এ জন্য পারতপক্ষে তাঁর সামনে গানই না। আজ রক্ষা, ডব্লিউ জি এদিকে খেয়াল করছেন না।

গান থামিয়ে ট্রাম্পারের কাঁধে হাত রেখে রঞ্জি বললেন, 'ডক্টরকে আমার সাসেক্স দলে দরকার ছিল। ওই ম্যাচের পরের সপ্তাহেই আমাদের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ ছিল। আমার বােলারদের মেরে ছাতু বানিয়ে দিয়েছিল ভিক্টর। ৩৮০ মিনিটে অপরাজিত ৩০০। এখনাে মনে আছে, চার মেরেছিল ৩৬টা। ওই ইনিংসের পরই কে যেন বলেছিল, ট্রাম্পার ফর্মে থাকলে কোনাে গুড লেংথ বল বলে কিছু নেই, সবই 'ট্রাম্পার লেংথ'!

বলের জন্য অপেক্ষায় ক্লেম হিল। ক্রিকেটের প্রথম বাঁহাতি গ্রেট। ছবি: গেটি ইমেজেস

হিলের মনে পড়ল, ট্রাম্পারের সঙ্গে তার ৬১ রানের ছােট্ট একটা পার্টনারশিপ হয়েছিল। পার্টনারশিপ হয়েছিল অধিনায়ক জো ডার্লিংয়েরও। ট্রাম্পারের ওই ইনিংসের পর মােহগ্রস্ত স্বরে বলেছিলেন, 'এত দিন ভাবতাম, আমি ব্যাটিং করতে পারি।'

জো ডার্লিংয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠায় আরেকটা ঘটনাও মনে পড়ে গেল হিলের। সেটি বলেই ফেললেন, 'হােভে ট্রাম্পার ওই ইনিঃসটি খেলার পর ড্রেসিংরুমের একটা ঘটনা বলি। ক্যাপ্টেন জো ডার্লিং আমাদের বললেন, আমার মনে হয় না, তােমরা আর কেউ ট্রাম্পারের মতাে ব্যাটিং করতে পারবে। আমি একটা ঘােষণা দিতে চাই, এই ট্যুরে সবাইকে ১০০ পাউন্ড করে দেওয়ার কথা ছিল। ট্রাম্পারকে আমি ৭০০ পাউন্ড দেব। হিল ট্রাম্পারের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললেন, 'আমার যে একটু হিংসা হয়নি, তা বললে মিথ্যা বলা হবে।'

অ্যাশেজের গল্প বলার কথা স্পফোর্থের। কথায় কথায় সেটি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আলফ্রেড শ-ই আবার প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনলেন সবাইকে, আরে, ডন অ্যাশেজের গল্প শুনবে বলে অধীর অপেক্ষায় আছে। আর তােমরা এ- ডাল থেকে ও-ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছ! ট্রাম্পারকে নিয়ে কথা শুরু করলে সহজে শেষ হবে নাকি? ওটা আরেক দিনের জন্য তােলা থাক। ফ্রেড আগে অ্যাশেজের গল্পটা বলুক।

বলছি, বলছি। স্পফোর্থ একটু আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর ব্র্যাডম্যানকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি রেজিনান্ড ব্রুকসের নাম শুনেছ?'

ব্র্যাডম্যান অবাক হয়ে বললেন, 'না তাে, এই নামে কোনাে ক্রিকেটারের কথা তাে শুনিনি।' স্পফোর্থ হাসলেন, 'আমি কি বলেছি ক্রিকেটার? যে অ্যাশেজ নিয়ে তােমার এত আগ্রহ, সেটি কিন্তু হয়েছে ওই ব্রুকসের কারণে।' ডব্লিউ জির আবছা আবছা মনে পড়ছে নামটা। তাই আরও মনােযােগ দিয়ে শুনতে লাগলেন স্পফোর্থের কথা, '১৮৮২ সালে ওভালের ওই টেস্টে আমরা, মানে অস্ট্রেলিয়ানরা ৭ রানে জিতেছিলাম। মাত্র ৮৫ রানের টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে ৭৭ রানেই অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ডক্টর একাই লড়ে ৩২ করেছিল। আগের ইনিংসের মতাে এবারও আমার ৭ উইকেট। কিন্তু তাতেই এই ম্যাচটা এমন বিখ্যাত হয়ে যেত না। হয়েছে ওই রেজিনাল্ড ব্রুকসের কারণে। নইলে ইংল্যান্ডকে হারানাে আর এমন কী? এর আগের আট টেস্টের চারটিই তাে আমরা জিতেছিলাম, ইংল্যান্ড জিতেছিল মাত্র দু'টিতে।'

খোঁচাটা নীরবে হজম করলেন ডব্লিউ জি, শও, লােহম্যানও। কথা তাে সত্যি। কোনাে প্রত্যুত্তর না পেয়ে মুচকি হেসে ফোর্থ বলতে লাগলেন, তবে হ্যা, ওই জয়টা একটু বেশিই আনন্দের ছিল। এর আগে এত কম ব্যবধানে কোনাে টেস্টের রেজাল্ট হয়নি। তা ছাড়া আমরা ফিল্ডিং করতে নামার সময়ই রাগে ফুঁসছিলাম। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর আগে আমিই ড্রেসিংরুমে বলেছিলাম, "দিস থিং ক্যান বি ডান।" আমাদের আসলে রাগিয়ে দিয়েছিল ডব্লিউ জি।

ডব্লিউ জির দিকে ঘুরে গেল সবার দৃষ্টি। তিনি দাড়িতে হাত বােলাতে বােলাতে মনােযােগ দিয়ে আকাশে উড়তে থাকা পাখি দেখতে শুরু করলেন। একসময় যে ঘটনায় রাগে ফুঁসছিলেন, এত বছর পর সেটি বলার সময় স্পফোর্থের মুখে হাসি, 'পাজিটা কী করেছিল জানাে, ডন? আমাদের ক্যাপ্টেন বিলি মারডক শর্ট লেগের দিকে একটা বল খেলে সিঙ্গেলের জন্য দৌড় দিলেন। ইংল্যান্ডের উইকেটকিপার আলফ্রেড লিটেলটন সামনে দৌড়ে গিয়ে বলটা হাতে নিতে নিতে রান হয়ে গেল। নন স্ট্রাইকার স্যামি জোন্স ক্রিজে পৌঁছে গেছে। লিটেনটন গ্লাভস খুলে বলটা ডব্লিউ জিকে গ্রো করেছিল। স্লিপ থেকে ও তখন উইকেটের পেছনে। জোন্স ভেবেছে, রান তাে কমপ্লিট হয়েই গেছে, বল এখন ডেড। উইকেটের একটু সামনে গিয়ে ও ব্যাট দিয়ে পিচ ঠুকতে শুরু করল, ওই যাকে বলে গার্ডেনিং। আর ডক্টর বেলস ফেলে দিয়ে আপিল করে বসল । আম্পায়ারের তাে আউট না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। পরের ব্যাটসম্যান ছিলাম আমি। রাগে গজরাতে গজরাতে নেমেছিলাম। সে কারণেই হয়তাে শূন্য রানেই আউট হয়ে গেলাম।'

ডব্লিউ জি এতক্ষণে একটা পাল্টা নেওয়ার সুযােগ পেলেন, 'অজুহাত দিয়াে না। আমি অমন না করলেও তুমি ডাকই মারতে। তুমি ব্যাটিং পারতে নাকি?'

'কী বললে? তুমি জানাে, টেস্টে আমার ফিফটি আছে? টেস্টে এগারাে নম্বর ব্যাটসম্যানের প্রথম ফিফটি ওটি। পরের ২১ বছর সেটি একমাত্রও হয়ে ছিল।' ১৮৮৫ সালে মেলবাের্নের ওই টেস্টে এখানকার আর কেউই ছিলেন না। তবে চার্লস ব্যানারম্যানের ছােট ভাই অ্যালেক খেলেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে শােনা গল্পটাই মিলিয়ে নিতে চাইলেন তিনি, 'ফ্রেড, ওই টেস্টে নাকি আম্পায়ার ছিল সাতজন?'

ঠিকই শুনেছ। সে এক মজার কাহিনি। মাঠে অবশ্য সাতজন নামেনি। যে দু'জনের আম্পায়ারিং করার কথা ছিল, তাদের একজন টেস্টের আগে হঠাৎ মারা গেলেন। আরেকজন কী কারণে যেন বেঁকে বসলেন। তাঁদের বদলি হিসেবে ঠিক করা হলাে জর্জ হজ ও জিম ফিলিপসকে। ইংলিশ খেলােয়াড়েরা আম্পায়ারদের খুব গালাগালি করছিল, এর প্রতিবাদে হজেস মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিলিপস অবশ্য যাননি। তাঁর সঙ্গে আম্পায়ারিং করার জন্য খুঁজে-টুজে তিনজনকে বের করা হলাে। ম্যাচের বিভিন্ন সময় ওই তিনজন আম্পায়ারিং করলেন। অদ্ভুত ঘটনা, আর কোনাে টেস্টে এমন হয়েছে বলে মনে হয় না। আম্পায়ারের কথা যখন উঠল, আরেকটা অদ্ভুত ঘটনাও তােমাদের বলি। সিডনিতে আগের টেস্টে আম্পায়ারিং করা "প্যাডি" ম্যাকশেনের এই টেস্টে অভিষেক হয়ে গেল।

ব্র্যাডম্যান শুনতে শুনতে ভাবছিলেন, কী বিচিত্রই না এই ক্রিকেট খেলাটার ইতিহাস! চাইলে প্রতিদিনই নতুন কিছু শােনা যায়। স্পফোর্থকে অ্যাশেজে ফেরাতে বললেন, 'আপনি রেজিনাল্ড ব্রুকসের কথা যেন কী বলছিলেন?'

'ও হ্যাঁ, বলছিলাম, যে অ্যাশেজ নিয়ে এত মাতামাতি, সেটি ওই রেজিনাল্ড ব্রুকসেরই অবদান। আমরা তাে ওই টেস্ট জিতে রাতে পার্টি-টার্টি করে ভােরবেলায় ঘুমিয়েছি। পরদিন মহা হইচই। ক্রীড়া সাপ্তাহিক স্পাের্টিং টাইমসে নাকি ইংলিশ ক্রিকেটের অবিচ্যুয়ারি ছাপা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইংলিশ ক্রিকেটকে দাহ করে সেটির ছাই অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়া হবে । দাঁড়াও, দাঁড়াও, ওই পেপার কাটিংটা আমি রেখে দিয়েছিলাম। প্রায়ই তা বের করে দেখতাম। দেখতে দেখতে সেটি আমার মনে গেথে গেছে। একটা কাগজ-কলম দাও, আমি একেবারে হুবহু সেটি তৈরি করে তােমাদের দেখাচ্ছি।'

ডব্লিউ জি বললেন, 'আমারও এখনাে সেটি চোখে ভাসে। ওই টেস্টের আগে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম, আর খেলব না। গ্রামে চলে যাব, ডাক্তারিতে মন দেব। ওই অবিচ্যুয়ারিটা দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল। ঠিক করলাম, প্রতিশােধ না নিয়ে বিদায় নেব না।

লােহম্যানের পকেটে সব সময়ই কাগজ-কলম থাকে। প্রায়ই আপন মনে কী যেন আঁকিবুঁকি করেন। স্পফোর্থকে তা বের করে দিলেন। ডব্লিউ জি অবাক হয়ে দেখলেন, স্পফোর্থ যেন ঠিক সেদিনের পত্রিকার ওই অংশটা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। ঝুঁকে পড়ে তা দেখতে দেখতে ব্র্যাডম্যান ভাবছিলেন, রেজিনকে রহস্যের সমাধান তো এখনো হলো না।

জর্জ লোহম্যান। ১৮ টেস্টে ১১২ উইকেট। গড়ে ৩৪ বলে ১ উইকেট বিস্ময় হয়ে আছে এখনো। ছবি: গেটি ইমেজেস

যেন তার মনের কথা পড়েই স্পফোর্থ বললেন, 'এই ব্যঙ্গ অবিচুয়ারিটা লিখেছিল রেজিনাল্ড ব্রুকস। ও ছিল সাংবাদিক ও লেখক। স্পাের্টিং টাইম এ কাজ করত। ওর আরেকটা পরিচয়, পাঞ্চ নামে ওই বিখ্যাত ব্যঙ্গ ম্যাগাজিনের সম্পাদক শার্লি ব্রুকসের ছেলে। পাঞ্চেও অনেক লিখেছে। এই অবিচ্যুয়ারি লেখার ছয় বছর পর মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই ও মারা যায়।'

ব্র্যাডম্যান অস্ফুটে বললেন, মরার আগে একটা কাজ করে গেছেন বটে।

 

* লেখকের 'কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্প' বই থেকে সংকলিত

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×