আজই কি স্বপ্নপূরণের দিন?

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৬

উৎপল শুভ্র

২৭ মার্চ ২০২১

আজই কি স্বপ্নপূরণের দিন?

টেস্ট অভিষেকের চার বছর দুই মাস পর ধরা দিয়েছিল সেই আরাধ্য স্বপ্ন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়! ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সেই জয় চিরদিনই অন্যরকম একটা জায়গা নিয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই টেস্টের প্রতিটি দিনই তাই আবার ফিরে দেখার মতো।

প্রথম প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০০৫। প্রথম আলো।

চট্টগ্রামে ফিরে ফিরে আসছে মুলতান। আসারই কথা। পাকিস্তানের ওই ধূলিধূসর শহরটির সঙ্গে যে সমার্থক হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ। ইনজামাম-উল হকের এক অতিমানবীয় ইনিংস, আম্পায়ারদের কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আর দুর্ভাগ্য মিলিয়ে দূর দিগন্তে দেখা দিয়েও মরীচিকার মতো মিলিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের স্বপ্ন। সেটিই আবার উঁকি দিচ্ছে চট্টগ্রামের আকাশে। আজই কি সেই স্বপ্নপূরণের দিন? 

মুলতানে খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল চতুর্থ দিনেই। সেদিন বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৪টি উইকেট, পাকিস্তানের ১১৩ রান। হয় বাংলাদেশ জিতবে নয় পাকিস্তান, সে টেস্টের সমীকরণে ড্রয়ের কোনো স্থান ছিল না। আজ চট্টগ্রাম টেস্টের পঞ্চম দিনের খেলা শুরুর আগেও এই ম্যাচের সম্ভাব্য ফল দুটিই। হয় বাংলাদেশের জয়, নয়তো ড্র। জিম্বাবুয়ের জয়ের কোনো সুযোগ নেই। জিততে হলে আজ শেষ দিনে টাইবুর দলকে করতে হবে ৩৩৫ রান। শেষ দিনে এত রান করে জয়ের ঘটনা টেস্ট ইতিহাসেই আছে কি না সন্দেহ!

পুরো দেশকে উৎসবে মাতিয়ে তুলতে বাংলাদেশের চাই ৭ উইকেট। যে স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম টেস্ট, প্রতিদিনই তা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। কাল ২৩ ওভারের মধ্যে জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসের ৩টি উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায়। এখানেই আবার আসছে মুলতান। জয়ের সঙ্গে দূরত্বটা তো আরও কম ছিল সেখানে। চট্টগ্রাম টেস্টও আরেকটি স্বপ্নভঙ্গের গল্প হয়ে যাবে না তো! 

অধিনায়ক হাবিবুল বাশার তা মনে করছেন না। ৭ উইকেট তুলে নেওয়ার কাজটাকে সহজ ভাবার ভুল তিনি করছেন না, তবে এই টেস্টে প্রথম চার দিনে দলের পারফরম্যান্স তাঁকে এতটাই সাহসী করে তুলেছে যে, সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণাই করে দিলেন, ‘জয়ের ব্যাপারে আমি পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী।’ 

তবে হাবিবুল বাশারের গলাটা কি কেঁপে গেল? গিয়ে থাকলে সেটির কারণ মোহাম্মদ রফিক। মুখে বলছেন, ‘আমার দলের চার বোলারই সমান গুরুত্বপূর্ণ’, কিন্তু মনে মনে অধিনায়কও জানেন, রফিকই তাঁর তুরুপের তাস। আর সেই রফিকেরই হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট! কাল রানার নিয়ে ব্যাট করেছেন, পরে বোলিংও করেছেন ৪ ওভার। আজও তিনি মাঠে নামবেন, তবে সেরা ফর্মের রফিককে পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে তো সংশয় থাকছেই। হাবিবুল অবশ্য অতটা চাইছেনও না, ‘রফিককে হয়তো শতভাগ ফিট পাওয়া যাবে না। তবে আশি ভাগ পেলেই আমি খুশি।’

মোহাম্মদ রফিক নন, কাল বিকেলে নিজের প্রথম দুই ওভারেই ২ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্নটা আরো উজ্জ্বল করে তুলেছেন অন্য একজন। তাপস বৈশ্য। ৩ ওভার শেষে তার বোলিং বিশে–ষণটা হলো দেখার মতো : ৩-৩-০-২! তিন ওভারে কোনো রান না দিয়ে ২ উইকেট! 

প্রথম ইনিংসে শুধুই দুর্ভাগ্যের কারণে উইকেটবঞ্চিত থাকা এনামুলের দিকে অবশেষে মুখ তুলে চেয়েছে ভাগ্যদেবী। মাৎসিকেনেরিকে বোল্ড করে বাংলাদেশকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন এই বাঁহাতি স্পিনার। বলতে পারেন স্বর্গের পথে আরেক ধাপ। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে যে জয়ের জন্য বাংলাদেশের ব্যগ্র প্রতীক্ষা, স্বর্গের সঙ্গে তো তার তুলনা করাই যায়। 

যে স্বপ্ন নিয়ে দিন শুরু করেছিল বাংলাদেশ, পূরণ হয়েছিল সেই স্বপ্ন।। ছবি: শামসুল হক টেংকু

তৃতীয় দিনটিই একটু বাংলাদেশের প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মেলায়নি। নইলে এই টেস্টে বাকি সব হয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যাশামতোই। কালও যেমন হলো। সকালে জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংসের বাকি ২ উইকেট তুলে নিতে আধঘণ্টা লেগেছে সত্যি, তবে ৯.৪ ওভারে জিম্বাবুয়ে তুলতে পেরেছে মাত্র ৪ রান। হোন্ডোকে যে ওভারে আউট করলেন মাশরাফি, তার পরের ওভারেই এনকালাকে ফিরিয়ে দিয়ে জিম্বাবুয়ের ইনিংস শেষ করে দিয়েছেন রফিক। টেস্ট ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেটও হয়ে গেছে তাঁর। 

এই টেস্টে অনেক কিছুই বাংলাদেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় ইনিংসটিও তা-ই। দ্রুত রান তুলে প্রতিপক্ষের সামনে একটা বড় টার্গেট ছুড়ে দিতে হবে—এই লক্ষ্য নিয়ে এর আগে কখনো ব্যাট করতে নামেনি বাংলাদেশ। অর্জিত হয়েছে সেই লক্ষ্যও। চা-বিরতির পর ৪০ মিনিট ব্যাট করে বাংলাদেশ যখন ইনিংস ঘোষণা করেছে, স্কোরবোর্ডে ৯ উইকেটে ২০৪। উইকেটের চেয়ে বাংলাদেশের ভাবনা ছিল রান রেট নিয়ে। সেই ভাবনারই ফসল ওভারপ্রতি প্রায় ৪ রান। ৫৫ রানের আর একটি দারুণ ইনিংস খেলে এখানেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। 

জিততে হলে জিম্বাবুয়েকে করতে হবে ৩৮১ রান। চতুর্থ ইনিংসে এর চেয়ে বেশি রান করেও জয়ের রেকর্ড আছে টেস্ট ক্রিকেটে। তবে সেগুলো এমনই বীরত্বব্যঞ্জক যে, রেকর্ডের পাতায় আলাদা একটা অধ্যায়ই বরাদ্দ আছে এ জন্য। জিম্বাবুয়ে সেটা করে ফেললে তা হবে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলোর একটি। এই টেস্টে বাংলাদেশের জন্য অপ্রত্যাশিত কিছু তো খুব বেশি ঘটেনি। শেষটাতে না ঘটলেই হলো!

আরও পড়ুন...
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-১
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-২
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৩
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৪
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৫
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৭
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৮

 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×