`আমি রেকর্ড করেছি, যারা দেখতে চায়, দেখুক`

উৎপল শুভ্র

২৩ মার্চ ২০২১

`আমি রেকর্ড করেছি, যারা দেখতে চায়, দেখুক`

কপিল দেব। ছবি: গেটি ইমেজেস্

১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে কলম্বোতে এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কপিল দেব জানেনও না, তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে পুরো ক্যারিয়ারেই যে দাড়ি পড়ে যাবে, তা বোধ হয় আঁচ করতে পারছিলেন। নইলে খেলা ছাড়ার প্রসঙ্গে কেন বলবেন, আমি এটাকে নিচ্ছি সিজন টু সিজন, সেশন টু সেশন হিসাবে

প্রথম প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪। ভোরের কাগজ।

উৎপল শুভ্র: একজন ক্রিকেটারের যা কিছু পাওয়া সম্ভব, সবই পেয়েছেন আপনি। কিন্তু নিজে কোন অর্জনটি নিয়ে সবচেয়ে গর্ব অনুভব করেন?

কপিল দেব: আমি যে দেশের পক্ষে খেলতে পেরেছি, আমার কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আপনি পনের-বিশ বছর ধরে খেলে গেলে রেকর্ড এমনিতেই আসবে। তবে একটা ব্যাপারে আমি খুব গর্ব অনুভব করি যে, আমি টানা ১৫/১৬ বছর ধরে ননস্টপ ক্রিকেট খেলে যাচ্ছি।

শুভ্র: এর পেছনে রহস্যটা কী, বলবেন? আপনি টানা ১৬ বছর খেলছেন, কিন্তু আজকাল পেস বোলাররা অনেক সময় নেটে গেলেও ইনজুরিতে পড়ে যায়।

কপিল দেব: রহস্য কিছুই না। এজন্য খুব ডিসিপ্লিনড হতে হয়, জীবন যাপনের ব্যাপারেও খুব সাবধান হতে হয়। আমি জানি না ওরা (এখনকার পেস বোলাররা) কেন এত বেশি ইনজ্যুরড হয়। আমি শুধু এটাই বলব, ডিসিপ্লিনড হওয়াটাই মূল কথা, কারণ পেস বোলার হওয়াটা হলো, ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন কাজ।

চিরচেনা সেই বোলিং অ্যাকশনে। ছবি: গেটি ইমেজেস্

শুভ্র: ক্যারিয়ার শুরু করার সময় কি ভাবতে পেরেছিলেন এত দূর আসবেন? 

কপিল দেব: না। খেলা শুরু করার আগে কিভাবে কেউ ভাবতে পারবে যে, সে কতদূর যাবে! তবে আমি শুরু থেকেই খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম । কিন্তু কখনোই ভাবিনি, এত দূর আসব।

শুভ্র: অসংখ্য কীর্তিই তো গড়েছেন আপনি। কিন্তু নিজে সবচেয়ে স্মরণীয় পারফরম্যান্স মনে করেন কোনটিকে?

কপিল দেব: আমি মনে করি, ১৬ বছর ধরে খেলে যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। দলের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আমরা জিততে শুরু করলাম দেশের বাইরে। বিশ্বকাপ জেতাটাও ছিল দারুণ ব্যাপার। এটা ভিন্ন একটা গুরুত্বের দাবিদার, কারণ বিশ্বকাপ জয় আমাদের দেশের ক্রিকেটকেই বদলে দেয়।

শুভ্র: আমি আসলে জানতে চাইছিলাম, আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কথা ।

কপিল দেব: আমি সবসময় দলের পারফরম্যান্সটাকেই গুরুত্ব দিই। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স আসে তার হাত ধরেই। কাজেই ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে গুরুত্বপূর্ণ-অগুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। দল জিতল কি-না, সেটাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

শুভ্র: কিন্তু কোনো একটা ম্যাচে আপনি ৯ উইকেট নিলেন বা দারুণ একটা সেঞ্চুরি করলেন, সেই  পারফরম্যান্সটা একটু আলাদাভাবে মনে থাকবে না?

কপিল দেব: ৫ উইকেট বা ১০ উইকেট পাওয়া বা সেঞ্চুরি করাটা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দিত হওয়ার মতো ঘটনা। তবে আমি এসব ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সকে কখনোই বেছে নিতে চাই না। ১৬ বছর ধরে খেলে গেলে সে রকম পারফরম্যান্স অনেকই হওয়ার কথা। আমি আসলে কখনোই নিজের ব্যক্তিগত কোনো পারফরম্যান্সকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে চাই না। 

সাত নম্বরে ব্যাটিং করে যা করেছেন, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। ছবি: এপি

শুভ্র: ঠিক আছে। তাহলে এটা বলুন, আপনি কি আপনার ব্যাটিং রেকর্ডে খুশি? প্রায় সবাই একমত, ব্যাট হাতে এর চেয়েও অনেক ভালো করার সামর্থ্য আপনার ছিল।

কপিল দেব: আমার ব্যাটিং রেকর্ড নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। যদি আপনাকে  সাত নম্বরে ব্যাটিং করতে হয়, যা আমি করি, তাহলে এর চেয়ে ভালো আর কী হবে? যদি আমি ৪ বা ৫ নম্বরে ব্যাটিং করতাম,  তাহলে হয়তো ব্যাপারটা অন্য রকম হতো। বিশেষ করে ওয়ানডেতে ৭ নম্বরে ব্যাটিং করে এত রান পাওয়ায় আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। কারণ বেশির ভাগ সময়ই ১০ ওভার, ১৫ ওভার বাকি থাকতে আমি ব্যাটিং করার সুযোগ পাই। এটা খুবই কঠিন। আমার মনে হয় না, আর কেউ সাত  নম্বরে ব্যাট করে আমার চেয়ে বেশি রান করেছে।

শুভ্র: ওয়ানডে ক্রিকেটের কথা যখন এলোই, ‘৮৩ এর বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অপরাজিত ১৭৫ রানের স্মরণীয় সেই ইনিংসটি সম্পর্কে কিছু বলুন।

কপিল দেব: সে ম্যাচে প্রায় সব ব্যাটসম্যানই আউট হয়ে গেল শুরুতেই। কাজেই আমাকে পুরো ৬০ ওভার খেলতে হতো। এটাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা। একটা সম্মানজনক স্কোর গড়ার ব্যাপারে আমরা ছিলাম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যখন আমরা ৫০-৫৫ ওভার কাটিয়ে দিলাম, তখন শুরু করলাম মার। শেষ ৫-৬ ওভারে আমরা ৭০-৮০ রান তুলেছিলাম। 

শুভ্র: আপনার এই ইনিংসটিকে মনে করা হয় ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা। 

কপিল দেব: মানুষ যদি তা বলে, তাহলে তা-ই। এটা তাদেরই বিচার করার কথা। 

শুভ্র: কিন্তু আপনি নিজে কি এটিকে ওয়ানডেতে আপনার সেরা ইনিংস মনে করেন?

কপিল দেব: নট রিয়েলি। বেশ কটি ইনিংস মনে পড়ছে। যেমন আমি এক ম্যাচে করেছিলাম ৮৯, আরেক ম্যাচে ৪২, আরেকটি ম্যাচে ৩২--হয়তো এমন আরও ছোট ইনিংস, যা দলকে জিতিয়েছে। যেখানে আমাদের দলের কোনো সুযোগই নেই বলে ধরে নিয়েছিল সবাই, তারপর ওই ইনিংসগুলো ম্যাচ জিতিয়েছে। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বেনসন এন্ড হেজেস মিনি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে শেষ ১২ ওভারে ৮ রান করে প্রয়োজন ছিল আমাদের। দিলীপ (ভেংসরকার) ছিল আমার সঙ্গে এবং আমরা দুই কি তিন ওভার বাকি থাকতেই খেলা শেষ করে দিয়েছিলাম। কাজেই আরও অনেক বড় রানের ইনিংসের চেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৫ রানও স্মরণীয়, কারণ দলের অবস্থাটা ছিল খুব নাজুক। তবে আমি । আরও অনেক ইনিংস মনে করতে পারি, যেগুলো আরও বেশি ইন্টারেস্টিং এবং একই সঙ্গে স্মরণীয়।

একসঙ্গে  বিশ্বকাপজয়ী তিন উপমহাদেশীয় অধিনায়ক। ছবি: এপি

শুভ্র: কিন্তু আপনার ওই ১৭৫ রানই ভারতকে বিশ্বকাপ জয়ের দিকে নিয়ে গেল। 

কপিল দেব: যার যা ইচ্ছা বলতে পারে। যদি আপনার তাই মনে হয় তাহলে তা-ই। আমি এসব মনে রাখি না। আমি খেলেছি এবং ভুলে গেছি। মানুষ যদি সেগুলো মনে রাখতে চায়, রাখবে। আমি রেকর্ড করেছি, কেউ যদি দেখতে চায় তো দেখুক।

শুভ্র: ষোল বছরের ক্যারিয়ারে অনেক বিখ্যাত ব্যাটসম্যানের বিপক্ষেই তো বোলিং করেছেন। সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে কাকে?

কপিল দেব: ক্রিকেটে সবসময়ই দুই ধরনের ব্যাটসম্যান থাকে, এক দলকে আমি রেসপেক্ট করি, অন্যদের করি ঘৃণা। রেসপেক্ট করি, ভিভিয়ান রিচার্ডস্, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেভিড গাওয়ার, জাভেদ মিয়াঁদাদের মতো ব্যাটসম্যানদের। এদের বিপক্ষে বোলিং করাটা আনন্দের, কারণ তারা সবসময়ই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসে। অন্যদিকে জিওফ্রে বয়কট, ক্রিস ট্যাভারে--এদের মতো ব্যাটসম্যান, যারা চ্যালেঞ্জ না নিয়ে শুধু উইকেটে পড়ে থাকতে চায়,তাদের বিপক্ষে বোলিং করাটা আমি কখনোই এনজয় করি না। এ কারণেই রবি শাস্ত্রীর বিপক্ষে বোলিং করেও কোনো দিন আনন্দ পাইনি আমি। যেসব ক্রিকেটাররা চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে ভয় পায় না, সবসময়ই আমি তাদের ভক্ত। যেমন ভিভিয়ান রিচার্ডস্ । 

শুভ্র: অনেকবার ফিসফাস শোনা গেলেও আপনি যে শেষ পর্যন্ত আর অধিনায়কত্ব ফিরে পাননি, এতে কোনো ক্ষোভ আছে?

কপিল দেব: না, কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো অনুতাপ নেই। কেন থাকবে? আমি পাঁচ/ছয় বছর অধিনায়ক ছিলাম । আই গট মাই শেয়ার।

শুভ্র: তার মানে কি আপনার ক্যাপ্টেনসি রেকর্ড নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট? 

কপিল দেব: খুবই সন্তুষ্ট। আমার যা কিছু অর্জন তাতে আমি পুরোপুরি খুশি। আই অ্যাম আ হ্যাপি ক্রিকেটার, আই অ্যাম আ হ্যাপি পারসন।

শুভ্র: এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান ও সেরা বোলার মনে করেন কাকে? 

কপিল দেব: যেভাবে ক্রিকেট যাচ্ছে, তাতে ব্রায়ান লারা ও শচীন টেন্ডুলকার দারুণ একটা নাড়া দিয়েছে ক্রিকেটকে। পাকিস্তানের বাসিত আলীও উঠে আসছে। সে ক্রমশই পরিণত হচ্ছে। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এই তিনজনের নাম করছি। বোলারদের মধ্যে পাকিস্তানের দুই ডব্লিউ, ওয়াসিম এবং ওয়াকার এখন অসাধারণ খেলছে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলারদের কথা তো আপনাকে সবসময়ই বলতে হবে। এখান থেকেএত ডজন ডজন ফাস্ট বোলার বেরিয়ে মাসছে যে, নির্দিষ্ট কারও নাম বলা কঠিন, তবে অ্যামব্রোস খুবই ভালো। অ্যালান ডোনাল্ডও ভালো করছে। তবে আমি মনে করি, পাকিস্তানিরা পেয়ার হওয়ায় তাদের একটা অ্যাডভানটেজ আছে। ওরা দুজন সবসময় পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আরও ভালো করে। দে আর রিয়েলি গুড বোলারস্।

মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে কপিল দেব। ছবি: অল স্পোর্ট/ইউকে

শুভ্র: ইমরান, বোথাম, হ্যাডলি ও কপিলের মতো অলরাউন্ডারকে একসঙ্গে পেয়েছিল ক্রিকেট। কিন্তু বর্তমানে আপনাদের উত্তরসূরি বিবেচিত হওয়ার মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? 

কপিল দেব: আমার মনে হয় এটা সাময়িক একটা শূন্যতা। ভালো অলরাউন্ডার অবশ্যইআসবে। বিশেষ করে বর্তমানে যে হারে ওয়ানডে খেলা হচ্ছে, তাতে অলরাউন্ডার আসতে বাধ্য।

শুভ্র: আপনার ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা যদি জানতে চাই...

কপিল দেব: টাই টেষ্ট (১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাদ্রাজে)।

শুভ্র: সে টেস্টে তো আপনি সেঞ্চুরি করেছিলেন।

কপিল দেব: সে কারণে নয়। আমার সেঞ্চুরিটা বড় ব্যাপার নয়, টেস্টটির সমাপ্তির কারণেই তা স্মরণীয়।

শুভ্র: অবসর নেওয়ার আগে নির্দিষ্ট কোনো কিছু অর্জনের লক্ষ্য আছে? 

কপিল দেব: আমি খেলতে চাই। যদি খেলে যাই, রেকর্ড এমনিতেই আসবে ।

শুভ্র: আর কত দিন খেলতে চান?

কপিল দেব: আমি জানি না। এখনও কিছুই ঠিক করিনি। আমি এটাকে নিচ্ছি সিজন টু সিজন, এমনকি বলতে পারেন সেশন টু সেশন হিসেবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×