‘আমি সাকিবের চিঠি পড়ি নাই, এটা কেমন কথা!’
উৎপল শুভ্র
২২ মার্চ ২০২১
সাকিব আল হাসানের ছুটি নেওয়া নিয়ে যে বিতর্কের সূত্রপাত, তা নতুন মাত্রা পেয়েছে তাঁর একটা ভিডিও সাক্ষাৎকারে। যেখানে ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খানের দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তিনি। আকরাম খান এতে শুধু ব্যথিতই নন, একটু বিস্মিতও। মুঠোফোনে নেওয়া আকরামের সেই সাক্ষাৎকার–
উৎপল শুভ্র: সাম্প্রতিক বিতর্কটা তো দেখছি অনেকটা 'সাকিব বনাম আকরাম'-এর রূপ নিয়েছে। প্রশ্নটা কীভাবে করব ভাবছি, আচ্ছা, আগে এ ব্যাপারটা আপনার রিয়্যাকশনটা জেনে নিই।
আকরাম খান: রিয়্যাকশন আর কি, এটা আসলে ভালো কিছু হচ্ছে না। আমরা দুজনই দেশের জন্য কাজ করছি। সাকিব খেলছে, আমার আর খেলার বয়স নাই বলে মাঠের বাইরে কাজ করছি। আমার মনে হয়, কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। সাকিব যে ধরনের কথাবার্তা বলছে, তা ঠিক কি না ও-ই তা বলতে পারবে। আমি সাকিবের চিঠিটা পড়ি নাই, এটা কেমন কথা! আমি এত বড় একটা দায়িত্বে, সাকিবের মতো প্লেয়ার একটা চিঠি দেবে, আর আমি সেটা পড়ব না? আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে এ সব কথাবার্তা। আমি মনে করি, আমরা একটা ফ্যামিলির মতো। টুকটাক কোনো ঝামেলা হতেই পারে, বাইরে না গিয়ে নিজেদেরই তা মিটিয়ে ফেলা ভালো।
শুভ্র: তাহলে সাকিব এমন বলছে কেন?
আকরাম: আমি জানি না। আমি যখন খেলতাম, তখন থেকেই তো আপনার সঙ্গে পরিচয়। আপনি ভালো জানবেন, আমি কখনো কাউকে ছোট করে কিছু বলি নাই। আমি এটাও কোনোদিন বলি নাই, সাকিব টেস্ট খেলতে চায় না। চিঠির কথাটাই ধরেন। সাকিব চিঠি দিয়েছে ক্রিকেট বোর্ডকে। আমি ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান, আমার কাছেও তা এসেছে। তাতে ও বলেছে, আপকামিং শ্রীলঙ্কা ট্যুরে না খেলে আইপিএল খেলতে চায়। মিডিয়া যখন জানতে চেয়েছে, সাকিব ওডিআই সিরিজে খেলবে কি না, তখন আমি বলেছি, ও ২টা টেস্টের জন্য ছুটি চেয়েছে। সবাই-ই তো জানে, শ্রীলঙ্কা ট্যুরে শুধু টেস্ট হবে। আমি বলিনি, সাকিব টেস্ট খেলবে না বা টেস্ট খেলতে চায় না। সাকিব তো আমাদের টপ প্লেয়ার, আমি ওর সম্পর্কে কেন, দলে শান্তর মতো ইয়াং কারও সম্পর্কেও কখনো কোনো খারাপ কথা বলি না।
শুভ্র্র: আপনি যে ফ্যামিলির উপমাটা দিলেন, আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিবও অনেকটা এই সুরেই কথা বলেছে। বলেছে, ক্রিকেট বোর্ড আর প্লেয়াররা মিলে একটা টিম। একসঙ্গে কাজ করা উচিত। আরেকটা কথাও বলেছে, দল ভালো করলে যদি ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি মানে আপনি কৃতিত্ব নেন, তাহলে হারলেও আপনাকে দায় নিতে হবে।
আকরাম: দেখেন, আমি ২০০৭ সাল থেকে বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত আছি। সিলেক্টর ছিলাম, পরে ডিরেক্টর হয়েছি। আমার সময়ে সাকসেসও তো কিছু আছে। কিন্তু আমি কখনো কি বলেছি, আমার জন্য তা হয়েছে। দল খারাপ খেললেও তো আমি কখনো ক্রিটিসাইজ করি না। আমি বললাম না, আমরা একটা ফ্যামিলির মতো। একটা সংসারের বড় সন্তান যদি ঠিক না থাকে, বাকিদের অবস্থাও তখন ভালো হয় না। আমরা সবাই দেশের জন্য কাজ করছি, কেউই নিজের জন্য কিছু করছি না। খেলার সময়ও আমি এভাবেই ভেবে এসেছি। আমাদের মধ্য কোনো সমস্যা হলে বাইরে না গিয়ে আমরা নিজেরা কথা বলেই তো তা সমাধান করতে পারি।
শুভ্র: সংসারের বড় সন্তান বলতে কি এখানে সাকিব আল হাসান?
আকরাম: শুধু সাকিব না। সাকিব আমাদের টপ প্লেয়ার, কিন্তু সিনিয়র অন্য যারা আছে, যেমন তামিম, মুশফিক, রিয়াদ ওদেরও কিন্তু অনেক দায়িত্ব আছে। ওদের কারও কাছ থেকে এমন কিছু শুনলে খারাপ লাগে।
শুভ্র: সাকিবের কথায় তো তাহলে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন ধরে নিচ্ছি...
আকরাম: তা তো পেয়েছিই। আমার নিজের চেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কথা ভেবে বেশি খারাপ লেগেছে...এমন সময়ে এসব কথাবার্তা হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ একটা সিরিজ খেলছে। সাকিব মিডিয়াতে বলেছে। এখন আমিও যদি বলি, দেশের ক্রিকেটের জন্যই তা খারাপ হবে। এমন চলতে থাকলে বাংলাদেশ কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো হয়ে যাবে।
শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো হয়ে যাবে মানে? ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো কদিন আগেই বাংলাদেশে ২-০-তে টেস্ট সিরিজ জিতে গেল!
আকরাম: তা জিতেছে। তবে আপনি তো জানেনই, ওরা কোথায় ছিল আর এখন কোথায় নেমে গেছে।
শুভ্র: সাকিবের ছুটি নিয়েই এই বিতর্কের সূত্রপাত। সেটাই আরও ডালপালা ছড়িয়েছে। বলেন তো, ছুটি দেওয়া নিয়ে আসলে কী হয়েছিল?
আকরাম: সাকিবকে ছুটি দিয়েছে বোর্ড। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত তো আমি একা দিতে পারি না। সবাই আলোচনা করেই তা দেওয়া হয়েছে।
শুভ্র: সাকিব একটু ক্ষোভের সঙ্গেই আমাকে বলেছে, ছুটি তো অন্যরাও নেয়। তাঁরটা নিয়ে এত কথা কেন?
আকরাম: এটা তো আমারও কথা। এত কথা কেন হবে? সাকিব ছুটি চেয়েছে, হয় দেব নয় তো দেব না। আমি তো ওর ছুটি নিয়ে কখনো কিছু বলি নাই।
শুভ্র: আমার মনে হয়, আপনি বলেছেন। টেলিভিশনে সাংবাদিকদের সঙ্গে সাকিবের ছুটি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে দেখেছি। পত্রপত্রিকাতেও পড়েছি বলে মনে পড়ছে।
আকরাম: আমি ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান। আমাকে মিডিয়া যদি জিজ্ঞেস করে, সাকিব শ্রীলঙ্কায় টেস্ট খেলবে কি না, আমাকে তো বলতেই হবে। কিন্তু বাড়তি কিছু তো বলি নাই।
শুভ্র: সাকিবকে তো পুরো আইপিএলের জন্য ছুটি দেওয়া হয় নাই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের জন্য ওকে আগেই চলে আসতে হবে। আমাকে বলেন তো, টেস্ট সিরিজে ছুটি দেওয়া হবে না ওয়ানডে সিরিজে - এমন কোনো আলোচনা কি হয়েছিল?
আকরাম: না, এমন কোনো আলোচনা হয়নি। ও শ্রীলঙ্কা ট্যুরের কথা উল্লেখ করেছে। শ্রীলঙ্কা ট্যুরে যে টেস্ট হবে, এটা তো সবাই জানে।
শুভ্র: বিভিন্ন সময় সাকিবের সঙ্গে বোর্ডের যে টুকটাক লেগেই যাচ্ছে, এর কারণটা কী? কোনো একটা ঝামেলা তো আছেই,তাই না?
আকরাম: আমার তা মনে হয় না। সাকিব যখন যা চাচ্ছে, বোর্ড তো তা-ই দিচ্ছে। এটা শুধু সাকিব বলে না, অন্যদেরও দিচ্ছে। এর আগেও তো ও ছুটি নিয়েছে। একবার ডিসিপ্লিনারি কারণ ছাড়া সাকিবের বিরুদ্ধে বোর্ড কখনো কিছু করেছে, বলেন?
শুভ্র: দল খারাপ করলে বিসিবি বা ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির দায় নেওয়ার প্রসঙ্গে আসি। আপনি তখন আরও কী যেন বলতে চাইছিলেন...
আকরাম: দেখেন, আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম, সিলেক্টর ছিলাম, এখন ডিরেক্টর। ক্যাপ্টেন থাকার সময়ও অনেকে আমার সমালোচনা করেছে, সিলেক্টর তো থ্যাংকলেস জব। কিন্তু নিজে খেলার সময়ও বলি নাই, জিতলে আমার কৃতিত্ব, এখনো বলি না। হারলে ক্রিটিসাইজও করি না। দল জিতলে সেটা প্লেয়ারদের কৃতিত্ব।
শুভ্র: আমি কিন্তু উল্টোটাই দেখে আসছি। জিতলে বিসিবির কর্মকর্তারা দলের সঙ্গে ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে যান। আর হারলে আমজনতার সুরে প্লেয়ারদের সমালোচনা করতে থাকেন...
আকরাম: ভাই, যাঁরা জীবনে কোনোদিন ছবিতে থাকে নাই, তারা অমন করতে পারে। আমার বা দুর্জয়ের ছবি পত্রিকায় অনেক পত্রিকায় অনেক ছাপা হয়েছে। আমার আর পত্রিকায় ছবি ছাপানোর লোভ নাই। কোনো ছবিতে যদি থাকতেই হয়,দেখবেন, আমি এক কিনারে দাঁড়িয়ে আছি।
শুভ্র: দুর্জয়ের কথা তুলে ভালোই করলেন। সাকিব তো ইন্টারভিউয়ে মূলত আপনার কমিটি আর দুর্জয় মানে নাঈমুরের এইচপি কার্যক্রমের সমালোচনা করেছেন। আপনাদের দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই এ নিয়ে কথা হয়েছে…
আকরাম: কাল (রোববার) সন্ধ্যায় প্রথম আমাদের দেখা হয়েছে। তবে আমরা মেইনলি টিম নিয়ে আলাপ করেছি, নিউজিল্যান্ডে প্রথম ম্যাচে পারফরম্যান্স নিয়ে কথা বলেছি
শুভ্র: কী বলছেন, আপনাদের সম্পর্কে সাকিবের কথা নিয়ে এত তোলপাড়, আর এ নিয়ে কথা হয়নি? আমি তো শুনলাম, সাকিবের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, এ নিয়ে কথা বলতে আপনারা বোর্ড সভাপতির বাড়িতে গিয়েছেন…
আকরাম: না, শুধু এটা নিয়ে কথা বলতে না। তাছাড়া আমি এখনো ইন্টারভিউটা দেখি নাই। আগে দেখি।
শুভ্র: এটাও তো অবিশ্বাস্য।
আকরাম: সত্যি বলছি। ছাড়া ছাড়া ভাবে একটু দেখেছি। পুরোটা আগে দেখি। আর এটা তো আমার বা দুর্জয়ের সিদ্ধান্ত না। সবাই মিলেই আলোচনা হবে।
শুভ্র: সাকিব যা বলেছেন, চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসাবে তা বলতে পারেন কি না, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু কথাগুলো তো সিরিয়াসলি নিয়ে তা খতিয়ে দেখা উচিত। আপনি কি বলবেন, আপনার ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি কি ঠিকভাবে কাজ করছে?
আকরাম: দেখেন, ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটিটা সবার জন্যই সহজ টার্গেট। দল ভালো করলে সব পজিটিভ। হারলে পরেই সমালোচনা। জেনেশুনেই আমি এখানে এসেছি। যখন খেলতাম, তখন থেকেই আমার এর সঙ্গে পরিচয় আছে। জিতলে সব ভালো, হারলে সব খারাপ। আর ক্রিটিসাইজ করার লোক সব সময় থাকেই। সাকিবের কিছু মনে হলে আমাদের তা বলতে পারে।
সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিয়েছে, আরও অনেক কিছু দিতে পারে। ও যখন প্রথম ক্যাপ্টেন হলো, আমি তখন সিলেক্টর। তখন ওকে বলেছিলাম, তোরা অনেক ভালো প্লেয়ার, তোরাই পারবি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে। শুধু সাকিব না; তামিম, মুশফিকদেরও অনেক দায়িত্ব আছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব, জুনিয়রদের গাইড করার দায়িত্ব।
শুভ্র: ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি নিয়ে যদি প্রশ্নটা আবার করি, আপনার কমিটি কি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে?
আকরাম: ক্রিকেট অপারেশন্সের সাফল্য-ব্যর্থতা আসলে দলের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি একটু ভেবে দেখেন, এই কমিটির আসলে কাজটা কী...ন্যাশনাল টিম আর ‘এ’ টিমের দেখভাল করা, তাই তো? দলের জন্য ভালো কোচ, ফিজিও, ট্রেনার আনা...সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। সেটা তো আমরা করছিই। আপনি তো জানেনই, বাংলাদেশে বিদেশি কোচ ধরে রাখা কিন্তু সহজ নয়। তারপরও আমরা অনেক ভালো ভালো কোচ এনেছি। কোর্টনি ওয়ালশ, ভেট্টোরির মতো বড় বড় প্লেয়াররাও আমাদের কোচ হয়ে এসেছে। বোর্ড টাকার কথাও চিন্তা করেনি। আমরা কিন্তু ভালোই এগোচ্ছিলাম। গত এক-দেড় বছরে করোনার কারণে একটু আটকে গেছি।
শুভ্র: শেষ প্রশ্ন, সাকিব তো দেশে ফিরছেন। সাকিবের সঙ্গে আপনার যে ধরনের সম্পর্কের কথা বললেন, তাতে কি ধরে নিতে পারি, আপনি নিজে থেকেই ওকে জিজ্ঞেস করবেন, ও কেন এসব বলেছে?
আকরাম: হ্যাঁ, করব। আমি তো বলেছিই, সাকিবের সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নাই। কোনো প্লেয়ারের সঙ্গেই নাই।