যে কারণে দেশে ফেরত পাঠানো হলো রফিককে

উৎপল শুভ্র

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

যে কারণে দেশে ফেরত পাঠানো হলো রফিককে

মোহাম্মদ রফিক: শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে যাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল জিম্বাবুয়ে সফর থেকে

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে অনেক কীর্তিতেই তিনি ‘প্রথম’। তবে কলংকের ‘প্রথম’-ও আছে তাঁর ক্যারিয়ারে। শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে কোনো ট্যুর থেকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হওয়া প্রথম ক্রিকেটারও মোহাম্মদ রফিক। ২০০৪ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে কী করেছিলেন তিনি?

প্রথম প্রকাশ: ১৪ মার্চ, ২০০৪। প্রথম আলো।

জিম্বাবুয়ে সফরের শুরু থেকেই সুখী এক পরিবারের মতো লাগছিল যে বাংলাদেশ দলকে, সেই দলেই এমন এক ঘটনা ঘটে গেল, যেটি আর যা-ই হোক, সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপন হতে পারে না। গতকাল হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের ভাগ্য নির্ধারণী ম্যাচ, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সামনে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের হাতছানি। অথচ সেই ম্যাচেই বাংলাদেশকে নামতে হলো দলের সেরা বোলার মোহাম্মদ রফিককে ছাড়া!  

বাংলাদেশ দল যখন মাঠে নামছে, তার ঘণ্টা তিনেক আগেই শৃঙ্খলাভঙ্গের গুরুতর অভিযোগ মাথায় নিয়ে হারারে ছেড়ে চলে গেছেন রফিক। আসলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর অপরাধ, হঠাৎ করেই মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুরো দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। দলের বাকি সব খেলোয়াড়ের সামনে অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছেন , মানজারুল ইসলাম রানাও শিকার হয়েছেন তাঁর দুর্ব্যবহারের।

ঘটনার সূত্রপাত গত পরশু দুপুরে। বাংলাদেশ দলের বিভিন্ন সূত্রে ঘটনার যে বিবরণ জানা গেল, তা এ রকম: 

হারারে স্পোর্টস ক্লাবে প্র্যাকটিস শেষ করার পর কিছুক্ষণ ড্রেসিংরুমেই ছিল বাংলাদেশ দল। টিভিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচই আসলে আটকে রাখছিল তাদের। হাবিবুল বাশার তখন ড্রেসিংরুমের সামনেই মাঠে। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ দলের তরুণ বাঁহাতি স্পিনার মানজারুল ইসলাম রানা। জিম্বাবুয়ের বাঁহাতি স্পিনার রেমন্ড প্রাইসও তখন সেখানে। প্রাইসের কাছ থেকে মানজারুল রানা যাতে কিছু টিপস পেতে পারেন, সে জন্যই তাঁকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন হাবিবুল। ড্রেসিংরুম থেকে এটি দেখেছেন মোহাম্মদ রফিক এবং দেখার পর তাঁর যে প্রতিক্রিয়া হলো, সেটি রীতিমতো অবিশ্বাস্য। দলে তিনি থাকতে রেমন্ড প্রাইসের কাছে পরামর্শ নিতে যেতে হবে কেন—এটাই নাকি ছিল রফিকের রাগের কারণ। মানজারুলকে নিয়ে হাবিবুল ড্রেসিংরুমে ফিরতেই রফিক তাঁদের ওপর গালাগালির বন্যা বইয়ে দেন। রফিকের এমন উত্তেজিত রূপ দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে পড়েন হাবিবুল। দলের বাকি খেলোয়াড়রা রফিককে থামানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। কোচ ডেভ হোয়াটমোরও এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।হাবিবুল বাশারের সঙ্গে মোহাম্মদ রফিক। এমনিতে বোলার রফিকের বড় ভক্ত হাবিবুল রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন রফিকের অমন আচরণে

ম্যানেজার এম এ লতিফের কয়েক দিন ধরেই জ্বর। কাল প্র্যাকটিসের শেষ দিকে তাই হোটেলে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। হোটেলে ফেরার পর তাকে সবকিছু জানানো হয়। ম্যানেজারের রুমে গিয়ে লজ্জায়-অপমানে কেঁদেই ফেলেন হাবিবুল বাশার। ঘটনার সময় ড্রেসিংরুমে ছিলেন খেলোয়াড়দের সবাই, ছিলেন কোচ ডেভ হোয়াটমোর, কম্পিউটার অ্যানালিস্ট নাসির আহমেদ নাসু। ঘটনার বিস্তারিত জানতে তাদের সঙ্গে কথা বলেন ম্যানেজার। ডেভ হোয়াটমোর পুরো ঘটনায় ক্ষুব্ধ তো হয়েছেনই, অবাকও হয়েছেন তার চেয়ে কম নয়। ম্যানেজারকে তিনি বলেছেন, তাঁর দীর্ঘদিনের খেলোয়াড়ি ও কোচিং ক্যারিয়ারে কোনো খেলোয়াড়কে অধিনায়কের সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করতে দেখেননি। 

অনুমান করা কঠিন নয়, মোহাম্মদ রফিককে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তেও বড় ভূমিকা রেখেছেন ডেভ হোয়াটমোর। নিজের চোখে সব দেখেছেন, দলের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই রফিকের কঠিন শাস্তি হওয়াটা জরুরি বলে মনে হয়েছে তাঁর কাছে। ম্যানেজারও একমত হয়েছেন তার সঙ্গে। 

পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে টেস্ট সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট নিয়েছিলেন রফিক, এখন আরেকটি ‘প্রথম’-এর সঙ্গেও জড়িয়ে গেল তাঁর নাম। এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়কে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে কোনো ট্যুর থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। 

রফিককে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে টিম ম্যানেজমেন্টের খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে তা কার্যকর করতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। ম্যানেজার জানালেন, বোর্ডের প্রধান নির্বাহী ম্যাকি দুদিয়া এবং জর্ডানে থাকা ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুব আনামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন তিনি। মোহাম্মদ রফিককে গত পরশু রাতেই জানিয়ে দেওয়া হয় এই সিদ্ধান্ত। গতকাল সকালে দলের লিয়াজোঁ অফিসারকে দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিমানবন্দরে। ভোরে মোহাম্মদ রফিক হোটেল ছাড়ার আগ পর্যন্ত টিম ম্যানেজমেন্ট খবরটা কাউকেই জানতে দেননি।

এই সফরের শুরু থেকেই হাবিবুল বাশার বলে আসছিলেন, অধিনায়কত্বটা যে তিনি খুব উপভোগ করছেন, তাতে তাঁর টিমমেটদের অনেক অবদান। সবাই তাঁকে খুব সাহায্য করছেন— এটা বলার পরপরই যোগ করতেন, এই দলে সমস্যা করতে পারে, এমন খেলোয়াড় কেউই নেই। মোহাম্মদ রফিক শুধু হাবিবুলকে ভুলই প্রমাণ করলেন না, ঢুকে গেলেন ‘রেকর্ড’ বুকেও। অবশ্য এটিকে যদি রেকর্ড বলেন!

পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশের প্রথম কোনো বোলার হিসেবে টেস্ট সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট নিয়েছিলেন রফিক, এখন আরেকটি ‘প্রথম’-এর সঙ্গেও জড়িয়ে গেল তাঁর নাম। এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়কে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে কোনো ট্যুর থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। 

ভারতের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান লালা অমরনাথ। কিন্তু লালা অমরনাথ নামটি এই রেকর্ডের সঙ্গে এটিও মনে করিয়ে দেয় যে, ১৯৩৩ সালে ভারতের ইংল্যান্ড সফর থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে ফেরত পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। অধিনায়ক সি কে নাইডুর নির্দেশ অগ্রাহ্য করার কারণেই এই শাস্তি— টিম ম্যানেজমেন্টের দেওয়া ব্যাখ্যাটা ঠিক কি না, তা এখনো ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসবিদদের গবেষণার বিষয়। অনেকেই এটিকে লালা অমরনাথের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখতে চান।

এর পর থেকে মোহাম্মদ রফিক সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনাতেও তাঁর বোলিং-কীর্তির সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবেই উচ্চারিত হবে এই শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত শাস্তির কথা। তবে এখানে ষড়যন্ত্র-টড়যন্ত্র খুঁজতে গেলে নিশ্চিত হতাশ হতে হবে। এই সফরে মোহাম্মদ রফিকের বোলিংয়ের সবচেয়ে বেশি প্রশংসা শুনেছি যাঁর মুখে, তাঁর নাম হাবিবুল বাশার।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×