ফেলপস-বোল্টের মতো অলিম্পিকটা তাঁদেরও!

বেইজিং অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

ফেলপস-বোল্টের মতো অলিম্পিকটা তাঁদেরও!

বেইজিং অলিম্পিকের দিকে ফিরে তাকালে প্রায় একই সঙ্গে মনে পড়ে দুটি মুখ। উসাইন বোল্ট আর মাইকেল ফেলপস। ওটা তো ফেলপস-বোল্টেরই অলিম্পিক। কিন্তু শুধু কি তাঁদেরই? নাতালি ডু টোইটের নয়? বা নাতালিয়া পার্তিকার? ইয়ান মিলারের বা ওকসানা চুসোভিটিনার? ওই অলিম্পিকটাকে তো তাঁরাও রঙিন করেছিলেন, অলিম্পিকে এসেই যাঁরা শিখিয়েছিলেন সেই পরম সত্য, 'মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়'।

প্রথম প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো

মাইকেল ফেলপসের অলিম্পিক না উসাইন বোল্টের? বেইজিং ২০০৮-কে কীভাবে মনে রাখবে ইতিহাস?

এক অলিম্পিকে মার্ক স্পিৎজের সাত সোনা জয়ের রেকর্ড কোনো দিন কেউ ভাঙতে পারবে কি না, সংশয় ছিল এ নিয়ে। ফেলপস ভেঙেছেন এবং ভাঙার পর সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘রেকর্ডের জন্মই মৃত্যুর লক্ষ্যে।’ তা-ই যদি হয়, তা হলেও প্রশ্নটা জাগেই। স্পিৎজের রেকর্ড ভাঙতেই নয়টি অলিম্পিক লাগল, ফেলপসেরটা ভাঙতে কয়টি?

আগামী অনেক অনেক বছর বেইজিং অলিম্পিকের কথা উঠলেই তাই মনে পড়বে বড় বড় কান আর আজানুলম্বিত হাতের এই জলমানবকে। তবে কারও যদি উসাইন বোল্টের কথাই আগে মনে পড়ে যায়, সেটিকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কিন্তু ফেলপস আগে না বোল্ট আগে? বোল্ট নিজেই বলেছেন, ফেলপস পানিতে আর তিনি ট্র্যাকে। কীভাবে দুজনের তুলনা হয়!

আসলেই হয় না। সোনার সংখ্যা দিয়ে তো অবশ্যই নয়। সেটি ন্যায়বিচারও হবে না। মূলত এক শ আর দুই শ মিটার সাঁতারেরই বিভিন্ন ধরনে ফেলপসের ৮টি সোনা। দৌড়ে তো আর সে সুযোগ নেই। যদি এমন হতো, ১০০ ও ২০০ মিটার দূরত্বে সামনে দৌড়-পেছনে দৌড়-তেরচা হয়ে দৌড়... এমন সব ইভেন্ট থাকত, বোল্ট কতগুলো সোনা জিততেন কে জানে! এমন হয় না বলেই সাঁতারে যেখানে সাতটি-আটটি সোনা নিয়ে কথা হয়, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এক অলিম্পিকে কেউ ৪টির বেশি সোনা জিততে পারে না। জেসি ওয়েন্স ও কার্ল লুইস দৌড়ের সঙ্গে লং জাম্পটাও পারতেন বলেই সম্ভব হয়েছিল তা। বোল্টের লং জাম্প প্রতিভার কথা শোনা যায়নি এখনো। ওয়েন্স ও লুইসের পাশে বসতে তা হলে কি তিনি ৪০০ মিটার দৌড়ানোও শুরু করে দেবেন?

বোল্টের কোচ তো অনেক দিন থেকেই বলছেন। ৪০০ মিটারের কিংবদন্তি মাইকেল জনসনও মনে করেন, এটিতেও সর্বকালের সেরাদের একজন হওয়ার প্রতিভা আছে জ্যামাইকান তরুণের। এই অলিম্পিকে যা করেছেন, তাতেই অবশ্য জেসি ওয়েন্সের সঙ্গে তুলনা হচ্ছে। করেছেন স্বয়ং আইওসি প্রেসিডেন্ট। তবে এক অলিম্পিকেই ১০০ ও ২০০ মিটারে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার কীর্তি ওয়েন্সেরও ছিল না। কারোরই নেই। বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ জেতার পর ৪০০ মিটার রিলেতেও কাল বোল্টের বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জয় ‘ফেলপসের না বোল্টের অলিম্পিক’—এই তর্ক আরও ঝাঁঝালো করে তুলল। সেই তর্ক চলুক।

তবে এটা তর্কাতীত যে, বেইজিং অলিম্পিকের দিকে ফিরে তাকালে প্রায় একই সঙ্গে মনে পড়বে এই দুটি মুখ। এটা ফেলপস-বোল্টেরই অলিম্পিক। কিন্তু শুধু কি তাঁদেরই? নাতালি ডু টোইটের নয়? বা নাতালিয়া পার্তিকার? ইয়ান মিলারের বা ওকসানা চুসোভিটিনার?

সাফল্যপিয়াসী এই সময়ে অলিম্পিক সোনা-রুপার হিসাব মেলাতে মেলাতে অনেক সময়ই আড়ালে পড়ে যায় এর চেয়েও বড় গল্প। মানুষের জয়ের গল্প। নাতালি ডু টোইটেরটা চাপা পড়েনি। ফেলপস-বোল্ট ইভেন্ট জেতার পর তাঁদের ঘিরে সাংবাদিকদের যেমন ভিড় হয়েছে, ডু টোইটকে ঘিরেও তার চেয়ে খুব কম নয়। সাত বছর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়ে ফেলা এই দক্ষিণ আফ্রিকান খোলা পানিতে ১০ কিলোমিটার সাঁতরে ২৫ জনের মধ্যে ১৬তম। আসলে তো অংশ নিয়েই ডু টোইট ‘প্রথম’। সাঁতার শেষে বিশেষ একটা ক্রেস্ট দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছে তাঁকে। এই ইভেন্টে সোনাজয়ী লারিসা ইচেঙ্কোর কাছে সেটি যথেষ্ট বলে মনে হয়নি, ‘ওকে তো একটা বিশেষ পদকই দেওয়া উচিত ছিল।’ দেওয়া হয়নি তো কি! অলিম্পিক পর্যন্ত আসতে পেরেই তো পদক জিতে গেছেন ডু টোইট।

১০ কি.মিতে না পারলেও ২০০ মিটার সাঁতারে ঠিকই স্বর্ণ জিতেছিলেন নাতালি ডু টোইট। ছবি: গেটি ইমেজেস

নাতালি ডু টোইটের মতো নাতালিয়া পার্তিকাও অলিম্পিক শেষে বেইজিংয়ে থেকে যাচ্ছেন। কদিন পরই শুরু হতে যাওয়া শারীরিক প্রতিবন্ধীদের প্যারা-অলিম্পিকে যে তিনিও আছেন। পোল্যান্ডের পার্তিকা খেলেন টেবিল টেনিস। জন্ম থেকেই ডান হাতের কনুইয়ের একটু নিচ থেকে আর কিছু নেই। অলিম্পিক টেবিল টেনিসে কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধী এই প্রথম। ডান কনুইয়ের ভাঁজে বল রেখে ওপরে ছুড়ে দিয়ে সার্ভিস করেন। তাড়াতাড়ি ঘুরে গিয়ে ব্যাট লাগাতে হয় বলে। শরীরের ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয়, তবে এটিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টার জোর প্রতিবাদ করেন নিজেই। ১৯ বছরের তরুণীর সব সময়ই বরং হাসিমুখ। প্যারা-অলিম্পিকে নিশ্চিত পদক জিতবেন। এখানে তো তিনি পদক জিততে আসেননি। এসেছেন মানুষের অসাধ্য কিছু নেই—এই বার্তাটা ছড়িয়ে দিতে।

ওকসানা চুসোভিটিনার গল্পটা অন্য রকম। চুসোভিটিনা জিমন্যাস্ট এবং ৩৩ বছর বয়সেও তিনি বেইজিং অলিম্পিকে! যে মেয়েদের জিমন্যাস্টিকসে ‘কুড়িতেই বুড়ি’ প্রবাদটা আক্ষরিক অর্থেই সত্যি, চুসোভিটিনা সেখানে রীতিমতো ‘নৈরাজ্য’। অর্ধেক বয়সী প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়ে ভল্টে রুপা জেতার পর জানিয়ে দিলেন, এখানেই শেষ নয়। লন্ডনে পরের অলিম্পিকেও থাকতে চান!

৩৩ বছর বয়সে মেয়েদের জিমন্যাস্টিকসে অলিম্পিক পদক জয়ই চুসোভিটিনার গল্পকে অন্য মাত্রা দিতে যথেষ্ট। তবে এটাই তো সব নয়। ভল্টে আটবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন চুসোভিটিনাকে আসল ভল্টটা তো জিততে হয়েছে জীবনে। ২০০২ সালে তিন বছরের ছেলে আলিশারের লিউকেমিয়া ধরা পড়ার পর তাঁর পাগলপ্রায় দশা। উজবেকিস্তানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কোলনে জিমন্যাস্টিকস জীবনের কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল, তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় জার্মানিতে গিয়ে আলিশারের চিকিৎসা করাতে পারলেন। আলিশার এখন প্রায় সুস্থই। দু বছর আগে জার্মানির নাগরিকত্ব নিয়েছেন চুসোভিটিনা। গত এপ্রিলে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ভল্টে সোনা জিতে প্রতিদানও দিয়েছেন। ২৩ বছরের মধ্যে এটি ইউরোপীয় পর্যায়ে জার্মানির পক্ষে মেয়েদের প্রথম সোনা। আসল রেকর্ড তো চুসোভিটিনার নিজের—সবচেয়ে ‘বুড়ো’ বয়সে বড় কোনো জিমন্যাস্টিকস শিরোপা জয়ের।

কুড়িতেই বুড়ি? তাহলে তেত্রিশের চুসোভিটিনা কী? ছবি: ইউরোপিয়ান ফটো এজেন্সি

বয়সটাকে শুধুই ‘সংখ্যা’ বানিয়ে ফেলা চুসোভিটিনা তাই বলতে পারেন, ‘বিজয়মঞ্চে দাঁড়ালে তখন কেউ জিজ্ঞেস করে না, বয়স পনেরো না ত্রিশ?’

ইয়ান মিলারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সগর্বে বলেন—এই তো আগামী জানুয়ারিতে আটষট্টি হবে! তার মানে এখন তাঁর সাতষট্টি। তা সাতষট্টি বছর বয়সে এই কানাডিয়ান অলিম্পিকে কী করছেন? নবমবারের মতো অংশ নিচ্ছেন! সেই ১৯৭২ মিউনিখ থেকে শুরু, মাঝখানে কানাডা বয়কট করায় শুধু ১৯৮০ মস্কো অলিম্পিকটাতেই থাকা হয়নি। নবমবারের চেষ্টায় এবার দাঁড়াতে পেরেছেন বিজয়মঞ্চে। গত সোমবার ইকুয়েস্ট্রিয়ানের শো জাম্পিংয়ে কানাডার হয়ে দলগত রুপা জয়ের পর ঘোষণা করে দিয়েছেন, ‘লন্ডনেও আমি আসছি!’

গত মার্চে ৩৯ বছরের সঙ্গী স্ত্রী মারা গেছেন। কয়েক সপ্তাহ পরেই মিলার নেমে গেছেন অলিম্পিকের প্রস্তুতিতে। স্ত্রীও তো এটাই চাইছেন! ৩৬ বছরের সাধনায় জেতা অলিম্পিক পদকটা স্ত্রী লিনকে উৎসর্গ করেছেন। লিন নাকি তাঁর সঙ্গেই ঘোড়ায় বসে ছিলেন!

এবার আপনিই বলুন, বেইজিং অলিম্পিক কি শুধুই ফেলপস-বোল্টদের? ডু টোইট-পার্তিকা-চুসোভিটিনা-মিলারদেরও নয়? ফেল্প্স-বোল্টের সাফল্যের মূলেও প্রায় সাধনায় রূপ নেওয়া পরিশ্রম, তবে তাঁরা তো জন্মেছেনই প্রকৃতিদত্ত প্রতিভা নিয়ে। সাধারণ মানুষ তাঁদের দিকে শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েই থাকতে পারে। প্রেরণা খুঁজতে তাকাতে হয় ডু টোইট-পার্তিকা-চুসোভিটিনা-মিলারদের দিকে, যাঁরা সবাইকে জানিয়ে দেন—মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×