কী হলো ‘কাস্ত্রোর মেয়েদের’!
বেইজিং অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
অলিম্পিকের ভলিবলে কিউবান নারীরা অপ্রতিরোধ্যই ছিলেন একটা সময়। 'কাস্ত্রোস গার্লস' নামে পরিচিত দলটা জিতেছিল ১৯৯২ থেকে ২০০০ অলিম্পিকের তিন স্বর্ণই, ছয়টা অলিম্পিকে তাদের পরাজয় ছিল মাত্র ৩ ম্যাচে। সেই দলটাই যখন বিদায় নিয়েছিল বেইজিং অলিম্পিকের সেমিফাইনালে, 'কী হলো কাস্ত্রোর মেয়েদের' প্রশ্ন তো উঠতেই পারে।
প্রথম প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো
বেইজিংয়ের মধ্যদুপুরে কোর্টের এক পাশে আমেরিকানরা যখন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ‘ইউ-ইউ-ইউ-ইউ এস এ’ বলে চিৎকার করছে, অন্য পাশে কিউবান মেয়েদের অনেকে কাঁদছে। কিউবানদের মধ্যে উচ্চতায় সবচেয়ে বেশি, ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির ন্যান্সি ক্যারিলো দেখা গেল কান্নাতেও সবচেয়ে বেশি পারদর্শী। দুহাতে মুখ ঢেকে তাঁর অঝোর কান্না দেখে সতীর্থদের অনেকে নিজেদের দুঃখ চাপা দিয়ে সান্ত্বনায় বুকে জড়ালেন ক্যারিলোকে। কোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও ক্যারিলোর চোখে রুমাল। ফিদেল কাস্ত্রো কি টেলিভিশনে দৃশ্যটা দেখছিলেন?
খেলাধুলায় খুব আগ্রহ। বড় অবদানও। বক্সিং হোক, হোক বেসবল বা অ্যাথলেটিকস, যেকোনো খেলাতেই কিউবার কোনো সাফল্যের পর নিশ্চিত শুনবেন, এর সবই বিপ্লবের পর কাস্ত্রোর নিজের ঠিক করে দেওয়া ক্রীড়াপরিকল্পনার ফল। কিউবার অন্য খেলাও দেখেন, তবে ভলিবল দলের কোনো খেলাই নাকি মিস করেন না। কালও কি দেখেছেন!
বেইজিংয়ের ক্যাপিটাল জিমনেসিয়ামে যখন কিউবান মেয়েদের স্বপ্নের সমাধি হলো, কিউবায় তখন গভীর রাত। ৮২ বছর বয়সী বিপ্লবী নেতার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়েও নানা রকম খবর। তার পরও যদি ম্যাচটা দেখে থাকেন, কাস্ত্রোর শরীর আরও খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা! কাতর হয়ে হয়তো তিনি উত্তর খুঁজেছেন—কী হলো আমার মেয়েদের!
কাস্ত্রোর মেয়েই! ‘কাস্ত্রোস্ গার্লস্’ নামেই পরিচিতি কিউবান মহিলা ভলিবল দলের, আর কাস্ত্রো তাদের আদর করে ডাকেন ‘মাই ফ্লাওয়ারস’। পুরো নব্বইয়ের দশক বিশ্ব ভলিবলে সুবাস ছড়ানোর পর সেই ‘ফুল’রা বেশ কিছুদিন ধরেই বিবর্ণ। আর কাল তো শুকিয়ে ঝরে পড়ার মতো অবস্থা!
১৯৯২ বার্সেলোনা থেকে ২০০০ সিডনি—টানা তিনটি অলিম্পিকের সোনা জিতেছে যে দল, গত ছয়টি অলিম্পিকে হেরেছে মাত্র ৩টি ম্যাচ, সেমিফাইনাল থেকেই তাদের বিদায় তো চরম ব্যর্থতাই। এথেন্সের মতো এখানেও তাই বড়জোর ব্রোঞ্জ। এসবের চেয়েও বড়, সেমিফাইনালে অমন অসহায় আত্মসমর্পণ। এসবের চেয়েও বড়, কাদের বিপক্ষে এমন পরাজয়!
২৫-২০, ২৫-১৬, ২৫-১৭! মাত্র সোয়া ঘণ্টায় সব শেষ। আর সেটি যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে বলে অসুস্থ কাস্ত্রোর আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা। কেন, তা আপনারও জানা থাকার কথা।
গ্রুপ ম্যাচে এই যুক্তরাষ্ট্রকেই ৩-০ সেটে উড়িয়ে দিয়েছে তারা। এথেন্সের চ্যাম্পিয়ন চীনের বিপক্ষে প্রথম দুই সেট হেরেও শেষ পর্যন্ত জিতেছে ৩-২ সেটে। সেমিফাইনালে ওঠার পথে হেরেছে মাত্র তিনটি সেট। আর যুক্তরাষ্ট্রকে ছয় ম্যাচের তিনটিই জিততে হয়েছে ৩-২ সেটে। হারতে হয়েছে মোট ১১টি সেট। সেমিফাইনালে ফেবারিট ছিল তাই কিউবাই। অথচ তিন সেটের কোনোটির ফলাফল নিয়েই বিন্দুমাত্র সংশয় পর্যন্ত জাগল না। ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই ব্যাগ গোছাতে গোছাতে কিউবান সাংবাদিক বললেন, ‘বেশি নাম-টাম হয়ে এই মেয়েগুলোর মাথা ঘুরে গেছে।’
টানা তিনটি অলিম্পিক জেতার পর টানা দ্বিতীয় অলিম্পিকের ফাইনালে উঠতে ব্যর্থতার আসল কারণ এটাই কি না, সেটি বলার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত লোক ইউজেনিও জর্জ। কিউবার টিম-শিটে তাঁর পরিচিতি ‘সহকারী কোচ’, তবে কিউবান মহিলা ভলিবলের আসল লোক ছোটখাটো দেখতে ৭৫ বছরের এই বৃদ্ধই। ১৯৬৯ সাল থেকে কিউবার মহিলা ভলিবলের সঙ্গে জড়িয়ে, অবকাঠামো-প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সব তাঁরই ঠিক করে দেওয়া, অলিম্পিকেও আসছেন সেই ১৯৭২ মিউনিখ থেকে। ২০০০ সালে প্রধান কোচের দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়ে নিজেই বেছে নিয়েছেন সহকারীর ভূমিকা। সব মিলিয়ে ব্রাজিলীয় ফুটবলের মারিও জাগালোর বন্ধু মনে হলো! ‘কিছুদিন আগেও প্রবল প্রতাপান্বিত কিউবান মেয়েদের এখন এমন দশা কেন’—মিক্সড জোনে ভিনদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নটা শুনে কিউবান ভলিবলের ‘মারিও জাগালো’ দুপাশে মাথা নাড়লেন। হয় ইংরেজি বোঝেন না, অথবা উত্তর তাঁরও জানা নেই।
পিং ল্যাং শুধু ইংরেজি বোঝেনই না, ভালো বলতেও পারেন। পারারই কথা। ২০০৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র মহিলা দলের কোচ, খেলোয়াড়ি জীবনেও নাকি টুকটাক বলতে পারতেন। এর আগে একবারই অলিম্পিক ভলিবলের ফাইনালে খেলেছিল মার্কিন মেয়েরা। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেসের পর বেইজিংয়ে আবার ফাইনাল। যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র সেই ফাইনালটির কথা পিং ল্যাংয়েরও খুব মনে আছে। ফাইনালে মার্কিন মেয়েরা যে দলের কাছে হেরেছিল, তিনি যে ছিলেন সেই চীনের সবচেয়ে বড় তারকা।
নিজেদের দেশে চীন নামছে এথেন্সে জেতা সোনা ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে, আর যুক্তরাষ্ট্রের কোচের ভূমিকায় পিং ল্যাং এসেছেন সেই স্বপ্ন ভেঙে দিতে। এ নিয়ে চীনে অনেক তোলপাড় হয়েছে। পেশাদার কোচিংয়ের জগতে নিজের দেশ-পরের দেশ অনেক দিনই কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে অনেক বছর নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা চীনাদের মানসিকতা এখনো এমন বিশ্বজনীন নয় বলে অনেকের কাছেই পিং ল্যাং হয়ে গেছেন ‘প্রতারক’। পিং ল্যাং শুধুই আর দশজন খেলোয়াড়ের একজন হলে হয়তো এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া হতো না। কিন্তু ল্যাং যে শুধু চীনা ভলিবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকাই নন, জাতীয় বীরও। কড়া স্পাইক (আমরা যেটিকে বলি ‘স্ম্যাশ’) করতে পারতেন বলে নাম হয়ে গিয়েছিল ‘দ্য আয়রন হ্যামার’, ১৯৮৬ সালে তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে, ছবি দিয়ে বেরিয়েছে ডাকটিকিট। বেইজিংয়ে আসার পর তাঁর জনপ্রিয়তা দেখে এক মার্কিন খেলোয়াড় বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলেছেন, ‘এ তো দেখছি, মাইকেল জর্ডানের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মতো অভিজ্ঞতা!’
সেই পিং ল্যাংকে নিজের দেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে অবশ্য দেখা হয়ে গেছে চীনাদের। গ্রুপ-পর্বের ম্যাচে পিং ল্যাংয়ের দল ৩-২ সেটে হারিয়েছে পিং ল্যাংয়ের দেশকে। সেই ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও। চীন ফাইনালে উঠলে আবারও নাকি যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ফাইনালটা যদি চীনের বিপক্ষেই হয়! পিং ল্যাং এই সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতেই রাজি হলেন না, ‘সে পরে দেখা যাবে। এখন আমাকে এই জয়টা উদ্যাপন করতে দিন।’ কালকের ম্যাচে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে অবশ্য মনে হলো, ব্যাপারটা তাদের সয়ে গেছে। গ্যালারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রই বেশি সমর্থন পেল। নিশ্চয়ই পিং ল্যাংয়ের সৌজন্যে। জয়ের পর দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন পিং ল্যাং। মার্কিন খেলোয়াড়েরা তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে কিশোরীর মতো কোর্টে লাফাচ্ছে।
গজ পনেরো দূরে ‘কাস্ত্রোর মেয়ে’দের চোখে তখন কান্নার পূর্বরাগ।