ইসিনবায়েভার বিশ্ব রেকর্ড আর এল গেরুজের স্বপ্নপূরণ
২০০৪ অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
অলিম্পিক মানেই তো কান্নার গল্প। কেউ সফল হয়ে কাঁদেন, কেউ বা ব্যর্থ হয়ে। হিশাম আল গেরুজ ও ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা অবশ্য কাঁদছিলেন সফল হয়ে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে যে অলিম্পিক সোনার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা সত্যি হয়েছিল যে!
প্রথম প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো
দৌড় হচ্ছিল, হার্ডলস হচ্ছিল, পোলভল্ট হচ্ছিল...একই সঙ্গে গত পরশু রাতে কান্নার একটা প্রতিযোগিতাও যেন চলছিল অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। শুরুটা করলেন বাহামার টনিক উইলিয়ামস-ডার্লিং। আগের দুই অলিম্পিকে সোনাজয়ী মেরি হোসে পেরেক ও ক্যাথি ফ্রিম্যানের সামনে ৪০০ মিটারের সোনা জিতে ল্যাপ অব অনারের সময় তো কাঁদলেনই, কাঁদলেন বিজয় মঞ্চে দাঁড়িয়েও।
টনিক উইলিয়ামসের কান্নাটা দুবারই আনন্দের। ইয়েলেনা ইসিনবায়েভার তা নয়। একই রাতে পুরো বিপরীত দুই অনুভূতি কাঁদিয়েছে তাঁকে। প্রথমবার হতাশা, দ্বিতীয়বার আনন্দ। যার সঙ্গে ইসিনবায়েভার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মেয়েদের পোলভল্টকে অন্য মাত্রা দিয়েছে, সেই সভেত্লানা ফিওফানোভা ৪.৭৫ মিটার লাফিয়ে ফেলেছেন, অথচ ৪.৭০ মিটারই পার হতে পারছেন না ইসিনবায়েভা। অলিম্পিক সোনার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে দেখে প্রথম কাঁদলেন এই সময়। মিনিট পনেরো পরই যখন দ্বিতীয়বার কাঁদছেন, পুরো স্টেডিয়াম ফেটে পড়ছে করতালিতে। বিশাল স্কোরবোর্ডে নেচে বেড়াচ্ছে দুটো শব্দ— ওয়ার্ল্ড রেকর্ড!
এথেন্স অলিম্পিকে তো প্রথমই, আটলান্টা অলিম্পিকে ২০০ মিটারে মাইকেল জনসনের পর অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে এটিই প্রথম বিশ্ব রেকর্ড। দিনের উজ্জ্বলতম তারকা কে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। অবশ্যই ৪.৯১ মিটার লাফিয়ে নিজের বিশ্ব রেকর্ডই ভেঙে দেওয়া ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা। তবে কান্নার যে প্রতিযোগিতার কথা বলছিলাম, তাতে বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে থেকে প্রথম হিশাম এল গেরুজ।
আনন্দাশ্রুই হোক আর দুঃখের কান্নাই হোক, অলিম্পিকে বেশির ভাগ সময় তা খেয়াল করে বুঝতে হয়। হিশাম এল গেরুজের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা ছিল না। ১৫০০ মিটার জয়ের পর রীতিমতো হাউমাউ করে কাঁদলেন তিনি। প্রথমে তাঁর গায়ে লেগে থেকে দ্বিতীয় হওয়া কেনিয়ার বার্নার্ড লাগাতকে জড়িয়ে ধরে। তারপর ট্র্যাকের ওপর শুয়ে। মরক্কোর তিন কর্মকর্তা ছুটে এলেন তাঁকে অভিনন্দন জানাতে। তাঁদের জড়িয়ে ধরেও কান্না। চার বছর আগে সিডনিতেও কেঁদেছিলেন, দুটোতে কত পার্থক্য! হিশাম এল গেরুজের মুখ থেকেই শুনুন, ‘চার বছর আগে আমি দুঃখে কেঁদেছিলাম, আজ কাঁদলাম আনন্দে। আজ আমি যেন পাঁচ বছরের এক শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম।’
হওয়ারই কথা। কত বছর ধরে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু এই মুহূর্তটির কথাই ভেবে এসেছেন এল গেরুজ। এমন কত হয়েছে, মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথাটা আর ঘুমুতে দেয়নি তাঁকে। এ জীবনে অলিম্পিক সোনা কি আর পাওয়া হবে না? ১৫০০ মিটার দৌড়ে অনেক দিন থেকেই তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্ব রেকর্ড তাঁর, গত চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপাও। গত আট বছরে হেরেছেন মাত্র চারবার। কিন্তু সেই চারবারের দুটিই যে অলিম্পিকে! সিডনিতে শেষ দিকে এসে নোয়া এনগেনি পেছনে ফেলে দিয়েছিলেন, এদিন বার্নার্ড লাগাত সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁকে। এ বছরই জন্মানো মেয়ে হিবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই শক্তি পেলেন এল গেরুজ। অলিম্পিকে এসেই বলেছেন, ‘আশা করি আমার মেয়ে বড় হয়ে বলতে পারবে, আমার জন্ম ২০০৪ সালে, যে বছর আমার বাবা অলিম্পিক জিতেছিল।’ এই চাওয়াকে সত্যি প্রমাণ করার তাড়নাই শেষ কয়েক মিটারে লাগাতকে পেছনে ফেলার শক্তি এনে দিল এল গেরুজের দু'পায়ে।
হিশাম এল গেরুজ যে ‘পাঁচ বছরের শিশু’র মতো কাঁদলেন, তার আরও কারণ আছে। শুধু তো অলিম্পিকে ব্যর্থতার ইতিহাস নয়, এবার আরও অনেক কাঁটা ছড়িয়ে ছিল তাঁর পথে। হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ায় অনেক দিন ঠিকমতো প্র্যাকটিস করতে পারেননি, র্যাঙ্কিংয়ে নেমে গিয়েছিল ৮ নম্বরে। একসময় এথেন্সে থাকবেন কি না, সংশয় দেখা দিয়েছিল তা নিয়েই। সেখান থেকে ফিরে হিশাম এল গেরুজ গ্রেটনেসের সর্বশেষ শর্তটি পূর্ণ করলেন।
ইয়েলেনা ইসিনবায়েভার ফেরাটাও কম নয়। স্বদেশী রুশ ফিওফানোভা তো বটেই, ৪.৭০ মিটার লাফিয়ে ফেলেছেন পোল্যান্ডের আনা রগোস্কায়াও। তিনি তা পারছেন না। অথচ ৪.৯০ মিটার লাফিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন দু'মাসও হয়নি। হতাশায় কেঁদেই ফেলেছিলেন ইসিনবায়েভা। ফিওফানোভা যখন ৪.৭৫ মিটারও পার হয়ে গেলেন, ইসিনবায়েভাকে ৪.৮০ মিটারের ঝুঁকি নিতেই হলো। এতে সফল হওয়াতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল অলিম্পিক সোনা। ফিওফানোভা ৪.৮০ মিটারের পর ৪.৮৫ মিটার লাফানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর ইসিনবায়েভার প্রতিযোগিতাটা ছিল শুধুই নিজের সঙ্গে। ৪.৮৫ মিটার লাফানোর পর ৪.৯০-ও টপকে গেলেন, এরপর বারটাকে ৪.৯১ মিটার ওপরে তুলে দিতে বললেন নিজেই। দৌড় শুরুকরার আগে সব সময়ই পোলটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলেন। এবার বললেন আরও বেশিক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১টা ছুঁই ছুঁই। তারপরও ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার ইচ্ছে স্টেডিয়ামে আটকে রাখল দর্শকদের। সাক্ষী তারা হলেনও।
ইসিনবায়েভা অবশ্য বিশ্ব রেকর্ডের চেয়ে অলিম্পিকে সোনা জয়টাকেই বড় করে দেখছেন, ‘অলিম্পিক চার বছরে একবার আসে আর বিশ্ব রেকর্ড তো সব সময়ই গড়া যায়।’ সেটি ইসিনবায়েভার চেয়ে ভালোভাবে আর কজন প্রমাণ করতে পেরেছে? গত এক বছরে ইনডোর-আউটডোর মিলিয়ে এটি তাঁর সপ্তম বিশ্ব রেকর্ড। এটা জেনে আপনার যাঁর কথা মনে পড়ছে, সেই সের্গেই বুবকাই তাঁর আদর্শ। ছেলেদের পোলভল্টে বুবকা যা করেছিলেন, মেয়েদের পোলভল্টে তা-ই করেছেন ইসিনবায়েভা। ফিওফানোভার সঙ্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা অ্যাথলেটিকসের অন্য ইভেন্টগুলোর তুলনায় অনেকটাই আনগ্ল্যামারস পোলভল্টকে নিয়ে এসেছে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই বিশ্ব রেকর্ডের পর তো আরও!
পাল্টে গেছে ইসিনবায়েভার জীবনও। বেশি লম্বা হয়ে গেছেন বলে কোচের কথামতো জিমন্যাস্টিকস ছেড়ে পোলভল্ট শুরু করেছিলেন। ‘ভাগ্যিস, কোচের কথা শুনেছিলাম’— এখন নিশ্চয়ই বলেন ইসিনবায়েভা। বাবা শ্রমিক, মা কিছু করেন না, টানাটানির সংসারে বড় হয়েছেন। একটি রুবলকেই যাঁর কাছে মহামূল্য বলে মনে হতো, সেই ইসিনবায়েভা এখন ডলারে ভাসছেন। প্রতিবার বিশ্ব রেকর্ড ভাঙলেই ৫০ হাজার ডলার পান স্পনসরদের কাছ থেকে। এ বছরই ভেঙেছেন ৬ বার, কী করবেন এত টাকা? ইসিনবায়েভা হাসতে হাসতে বললেন, ‘একটা ইয়ট কিনব। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন।’